এক সময়ে সংসদে সবচেয়ে প্রাধান্য ছিল আইনজীবীদের তা আস্তে আস্তে এখন রাজনীতিতে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন ব্যবসায়ীরা। ক্রমান্বয়ে সংসদে পেশাদার রাজনীতিবিদের হার কমছে ।
এবারের একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ২০ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে ২ জন প্রার্থী পেশাদার রাজনীতিবিদ।
দুই জোটের ৬০০ প্রার্থীর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেওয়া হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। হলফনামায় সাতজন প্রার্থী নিজেকে একই সঙ্গে রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মধ্যে মহাজোটের ছয় ও ঐক্যফ্রন্টের একজন।
রাজনীতির কেন্দ্রস্থল জাতীয় সংসদে পেশাদার রাজনীতিবিদেরা অনেক আগে থেকেই সংখ্যায় কমতে শুরু করেছেন। এবারের নির্বাচনেও তাঁরা নিরঙ্কুশভাবেই সংখ্যালঘু থাকবেন। কারণ, মহাজোট ও ঐক্যফ্রন্ট থেকে মনোনয়ন পাওয়া সব কজন রাজনীতিবিদ নির্বাচিত হয়ে এলেও তাঁদের মোট সংখ্যা হবে ২২। অর্থাৎ সংসদের মাত্র ৪ শতাংশ হবেন ঘোষিত রাজনীতিক। আর হলফনামায় যে সাতজন নিজেদের রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী বলেছেন, তাঁরা সবাই নির্বাচিত হলেও সংসদে তাঁরা সংখ্যালঘুই থেকে যাবেন। আর তাঁদের মধ্যে কেউ নির্বাচিত হতে না পারলে এই হার আরও কমবে।
বিগত কয়েকটি সংসদের মতো একাদশ জাতীয় সংসদেও ব্যবসায়ীদের একচ্ছত্র প্রাধান্য বজায় থাকার স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কারণ, হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সব পেশার সম্মিলিত যতজন সদস্য মনোনয়ন পেয়েছেন, তার চেয়েও বেশি মনোনয়ন পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। দুই প্রধান জোটেই ব্যবসায়ীরা সমান গুরুত্ব পেয়েছেন। দুই জোটের ৬০০ প্রার্থীর মধ্যে ৩২৯ জন বা প্রায় ৫৫ শতাংশ প্রার্থী পেশায় ব্যবসায়ী।
তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ১৫৩ জন বা ৫১ শতাংশ। আর ঐক্যফ্রন্টের ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১৭৬ বা প্রায় ৫৯ শতাংশ। ব্যবসা পেশার এই প্রার্থীদের মধ্যে ভুসি মালের ব্যবসায়ী থেকে ওষুধ কোম্পানির মালিক পর্যন্ত আছেন।
আগামী নির্বাচনে ব্যবসায়ী প্রার্থীদের হিসাব-নিকাশ এখানেই শেষ নয়। কারণ, এমন অনেক প্রার্থী আছেন, যাঁরা অন্যান্য পেশার পাশাপাশি ব্যবসাও করেন বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। যেমন কৃষিকাজের পাশাপাশি ব্যবসা করেন, এমন প্রার্থী দুই জোট থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন মোট ৪২ জন। তাঁদের মধ্যে মহাজোটের ২২ জন। আর ঐক্যফ্রন্টের ২০ জন।
তাঁদের ব্যবসায়ীর তালিকায় ধরলে দুই জোটের সর্বমোট প্রার্থীর সংখ্যা ৩৮২, যা দুই জোটের ৬০০ প্রার্থীর প্রায় ৬৪ শতাংশ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান ও ক্রিশ্চিয়ান মিচেলসন ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক ইঙ্গে আমুন্ডসন ২০১২ সালে যৌথভাবে ‘বাংলাদেশের সংসদ: প্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহি’ (দ্য পার্লামেন্ট অব বাংলাদেশ: রিপ্রেজেন্টেশন অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিবিলিটি) শিরোনামে একটি গবেষণা করেন। ওই গবেষণায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ১৯৭০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত সাংসদদের পেশা বিশ্লেষণ করা হয়।
ওই গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি, ৩০ শতাংশ ছিলেন আইনজীবী। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি মিলে ছিলেন ২৭ শতাংশ। রাজনীতিবিদ ছিলেন ৫ শতাংশ। সামরিক-বেসামরিক আমলা ছিলেন ৩ শতাংশ।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সংসদ নির্বাচনে আইনজীবী নির্বাচিত হন ২৭ শতাংশ এবং ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ছিলেন ২৪ শতাংশ। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে হঠাৎ করেই ব্যবসায়ীদের হার লাফিয়ে ৫৩ শতাংশে ওঠে। অন্যদিকে আইনজীবী সদস্যের হার কমে দাঁড়ায় ১৯ শতাংশ। সামরিক-বেসামরিক আমলাদের হারও বেড়ে হয়ে যায় ৮ শতাংশ। এরপর থেকে ব্যবসায়ীদেরই বাড়বাড়ন্ত চলে আসছে। ১৯৯৬,২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে ব্যবসায়ী সাংসদদের হার হয় যথাক্রমে ৪৮,৫৭ ও ৫৬ শতাংশ।
জাতীয় সংসদে রাজনীতিকদের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং ব্যবসায়ীদের ক্রমাগত প্রাধান্য সম্পর্কে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, রাজনীতি যে ব্যাপকভাবে ব্যবসায়িকীকরণ হয়েছে, এই মনোনয়নে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছেন। রাজনীতি থেকে তাঁরা মুনাফা করতে চান। এতে রাজনীতির জনকল্যাণের দিকটি বিলুপ্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, বোঝাই যাচ্ছে, ভবিষ্যতের সংসদ প্রতিনিধিত্বমূলক হবে না। সংসদ ব্যবসায়ীদের কোটারি স্বার্থ রক্ষা করে চলবে।
আইনজীবী
২০০৮ সালে সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের মধ্যে আইনজীবী ছিলেন প্রায় ১৫ শতাংশ। এবারের নির্বাচনে মহাজোট ৩৬ ও ঐক্যফ্রন্ট ২৯ জন আইনজীবীকে প্রার্থী করেছে। দুই জোট মিলে আইনজীবী প্রার্থীর হার দাঁড়ায় ১১ শতাংশের মতো।
পেশাজীবী
পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব জাতীয় সংসদে কমে আসছে। প্রথম জাতীয় সংসদে ১৫ শতাংশ আসন ছিল শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ ইত্যাদি পেশাজীবীদের দখলে। নবম জাতীয় সংসদে ওই হার কমে ৭ শতাংশে নামে। এবারের নির্বাচনে দুই জোট থেকে ৩৬ জন পেশাজীবী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন। অর্থাৎ পেশাজীবী মনোনয়ন পেয়েছেন মাত্র ৬ শতাংশ।
শিক্ষিত মানুষের সংসদ
স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও উচ্চতর ডিগ্রিধারী মোট ৪৮৯ জনকে মনোনয়ন দিয়েছে দুই জোট। এ ক্ষেত্রে দুই জোটের অবস্থান সমানে সমান। মহাজোট থেকে স্নাতক পাস ১২৯ জনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট দিয়েছে ১২৮ জনকে। স্নাতকোত্তর ১০৫ জন মনোনয়ন পেয়েছেন ঐক্যফ্রন্ট থেকে। মহাজোট থেকে পেয়েছেন ১০২ জন। উচ্চতর ডিগ্রিধারী ১৩ জন মনোনয়ন পেয়েছেন মহাজোট থেকে। একই পর্যায়ের ডিগ্রিধারী ১২ জন মনোনয়ন পেয়েছেন ঐক্যফ্রন্ট থেকে।
কোন পর্যায়ের শিক্ষা অর্জন করলে মানুষ স্বশিক্ষিত হয়, তার কোনো মাপকাঠি নেই। এ ক্ষেত্রে দুই জোটের অবস্থান সমান। প্রতিটি জোটের ৯ জন করে ১৮ জন হলফনামায় লিখেছেন, তাঁরা ‘স্বশিক্ষিত’। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস প্রার্থীও দুই জোটেই প্রায় সমান। দুই জোটেরই একজন করে প্রার্থী শিক্ষা সম্পর্কে হলফনামায় কিছু লেখেননি।
সূত্র ঃ প্রথম আলো