ঢাকা, ২৯ জুলাই- জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশের নাম ব্যবহার করে ইউরোপে পণ্য রফতানি করছে বিভিন্ন দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ২৮ দেশে যেসব দেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা বা জিএসপি পায় না, এ রকম দেশই শুল্ক ফাঁকি কিংবা উচ্চ হারের শুল্ক এড়াতে এই জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে থাকে। সর্বশেষ গত মে মাসে বাংলাদেশের দুটি ব্র্যান্ডের নাম ব্যবহার করে সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে ১১ হাজার পিস সাইকেল রফতানির ৫টি চালান আটক করেছে জার্মানির শুল্ক কর্তৃপক্ষ। জার্মানি থেকে পোল্যান্ড ও ক্রোয়েশিয়ায় নেওয়ার কথা ছিল সাইকেলগুলো।

আটক করা চালানের বিপরীতে ইস্যু করা জিএসপি সনদের সত্যতার বিষয়ে তদন্ত করছে ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) দুর্নীতি দমন অফিস (ওলাফ)। তদন্তের অংশ .হিসেবে ইসি সদর দপ্তর ব্রাসেলসে বাংলাদেশ দূতাবাসে চিঠি দেওয়া হয়েছে ওলাফের পক্ষ থেকে। এ বিষয়ে তদন্ত করছে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। ইপিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশি কোম্পানির নামে ওই ৫টি চালান আসলে চীন এবং শ্রীলংকা থেকে পাঠানো হয়েছে। পণ্যের কান্ট্রি অব অরিজিন প্রমাণে ইপিবির কর্মকর্তারা জিএসপি সনদে সই করে থাকেন। চালান ৫টিতে কর্মকর্তাদের সই রয়েছে। তবে এ সইগুলো জাল।

ইপিবি সূত্রে জানা গেছে, সন্দেহজনক চালানের বিষয়ে ব্রাসেলসে বাংলাদেশ দূতাবাসকে লেখা ওলাফের চিঠিতে প্রতিষ্ঠিত একটি কোম্পানির দুটি ব্র্যান্ডের সাইকেলের সন্দেহজনক চালানে জিএসপি সনদ দেওয়ার তারিখ, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নাম, শিপিং বিলসহ যাবতীয় তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এই জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে গত মে মাসের বিভিন্ন সময়ে। চিঠিতে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশের মতামত এবং যাচাই প্রতিবেদন চাওয়া হয়। দূতাবাসের কাউন্সিলর এবং হেড অব কমার্স উইং মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম ই-মেইল বার্তায় ইপিবিকে বিষয়টি জানিয়ে মতামত চেয়েছেন। এরপরই তদন্তে মাঠে নামে ইপিবি। এর মধ্যেই ওলাফের তদন্ত কর্মকর্তা ওলিভার বোন্নামি সরাসরি ইপিবির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনিও সবিস্তারে তথ্য উল্লেখ করে ‘ভেরি ভেরি আর্জেন্ট’ উল্লেখ করে ইপিবির যাচাই প্রতিবেদন চেয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তদন্তে ইপিবি প্রমাণ পেয়েছে ১১ হাজার পিস সাইকেলের ওই ৫ চালান আসলে জাল। বাংলাদেশ থেকে ওই সাইকেলগুলো রফতানি করা হয়নি। গত সপ্তাহে তদন্ত প্রতিবেদন এবং বাংলাদেশের মতামত ওলাফ এবং ব্রাসেলসের বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানিয়ে দেওয়া হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইপিবির শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু ইউরোপে শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা ভোগ করে, সে কারণে জিএসপি জালিয়াতির কোনো প্রয়োজন হয় না। তবে ওইসব প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বিদেশি কোম্পানিগুলো এ ধরনের সুবিধা নিয়ে থাকতে পারে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) নীতিতে ইইউর ২৮ দেশে পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। এসব দেশে রফতানিতে ১২ শতাংশ শুল্ক দিতে হয় চীন, শ্রীলংকাসহ অন্যান্য দেশের পণ্যে। এ ছাড়া ইইউতে চীনের বিভিন্ন পণ্যের একচেটিয়া বাজার দখলমুক্ত করতে অ্যান্টিডাম্পিং ডিউটি রয়েছে। শুল্ক এড়াতে ওইসব দেশের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এ ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

গত বছরের মার্চেও জিএসপি সনদ জালিয়াতির এরকম ২৩৬টি চালান আটক করা হয়। বাইসাইকেল, তৈরি পোশাক, সিরামিক টেবিল অয়্যার, গ্গ্নাস ফাইবার ম্যাস ফ্যাব্রিক্স (বিশেষ ধরনের কাপড়), নাট-বল্টুর ওই চালানের বিষয়ে তদন্ত করতে ওলাফ কর্মকর্তারা ঢাকায় আসেন। দুই সপ্তাহের পরিদর্শনে এসে তারা ইপিবি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট রফতানিকারকদের সঙ্গে কথা বলেন। পরিদর্শনে সন্দেহজনক অনেক প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব মেলেনি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে রফতানি করা পণ্যের মিল পাওয়া যায়নি। তদন্ত শেষে ওলাফ কর্মকর্তারা নিশ্চিত হন, সন্দেহজনক চালানের এসব পণ্য চীন এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে রফতানি হয়েছে। উচ্চ হারের শুল্ক এড়াতে শুল্কমুক্ত সুবিধাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের নাম ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র।

জালিয়াতির ঘটনা রফতানিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে_ এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, জিএসপি জালিয়াতি হলে আপাতদৃষ্টিতে আর্থিক কোনো অসুবিধা হয় না বাংলাদেশের। তবে রফতানি বাজারে দেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। কোনো পণ্যের চালানে জালিয়াতির সন্দেহ হলে সে পণ্যে আর শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকে না। নিয়মিত শুল্ক দিয়েই বন্দর থেকে ওই পণ্য ছাড় করতে হয়। এতে ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং রফতানিকারক দেশের প্রতি আস্থা হারায়। বাকি ক্রেতারাও এতে প্রভাবিত হন। ফলে গোটা রফতানিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে।

লেখক : আবু হেনা মুহিব

সূত্র : দেশে বিদেশে