কেউ বলছেন এবার কিন্তু এটা শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আবার অন্য আর একটা চ্যানেলের মতে এটা ভারতীয় ক্রিকেট দলের জন্য চূড়ান্ত অসম্মান। ব্যাপারটাকে স্রেফ রসিকতা হিসেবেও কেউ কেউ নিচ্ছেন না যে তা-নয়, তবে প্রথম আলোতে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি ক্রিকেট-বিজ্ঞাপনকে ঘিরে ভারতের সংবাদমাধ্যম আর ক্রিকেট-পন্ডিতরা যে বেজায় খাপ্পা তা বললে ভুল হবে না বিলকুল!

বিজ্ঞাপনটার কথা এতক্ষণে হয়তো অনেকেরই জানা। প্রথম আলোর সাময়িকী রস-আলোতে প্রকাশিত সেই ‘মুস্তাফিজ কাটারে’র বিজ্ঞাপনে অর্ধেক মাথা-মোড়ানো ভারতীয় ক্রিকেটারদের ছবি দিয়ে জানানো হয়েছে এই কাটার ‘আমরা ব্যবহার করেছি, আপনারাও করুন’। আদ্ধেক ন্যাড়া কোহলি-ধোনি-শিখর ধাওয়ানরাই বিরস বদনে সেই পোস্টার ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আর সেই বিজ্ঞাপনের ঝাঁজে রাগে গরগর করছে ভারতের ক্রিকেট মহল!

কাটার বলতে এখানে আসলে মুস্তাফিজের সেই মারাত্মক ডেলিভারিটাই যে বোঝানো হচ্ছে, যাতে ওয়ান ডে সিরিজে বাঘা বাঘা ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা ঘায়েল হয়েছেন, বুঝতে অবশ্য কোনও অসুবিধাই হচ্ছে না।

দেশের শীর্ষস্থানীয় টিভি চ্যানেল এনডিটিভি-তে যেমন এদিন দুপুর থেকেই এই বিজ্ঞাপন নিয়ে তুমুল তর্কাতর্কি চলছে। চ্যানেলের উপস্থাপিকা সরাসরি সেখানে বলছেন, ক্রিকেট বিজ্ঞাপন নিয়ে গত বেশ কিছুদিন ধরেই ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে তরজা চলছে সেটা ঠিকই, কিন্তু এবারে বোধহয় তা সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে, এটা পরিষ্কার ‘বিয়ন্ড দ্য বাউন্ডারি’।

জি নিউজ তো আরও এক ধাপ এগিয়ে মন্তব্য করেছে ভারতীয় দলের জন্য এত বড় অসম্মান, ‘আটার ডিসরেসপেক্ট’ ভাবাই যায় না! ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে শুরু করে দেশের অন্যান্য সংবাদমাধ্যমেরও মোটামুটি একই রকমের রায়!

কেন বাংলাদেশ এভাবে ভারতকে খোঁচা দিতে চাইছে, তা নিয়ে ভারতের ক্রিকেট পন্ডিতদের ব্যাখ্যাও মিলছে হাতে-গরম।

দেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেট সাংবাদিকদের একজন দেবাশিস দত্ত যেমন পরিষ্কার বলছেন এটা আসলে ১৯ মার্চের জ্বালা মেটানো ছাড়া কিছুই নয়। তার কথায়, ‘বিশ্বকাপে ভারতের কাছে সেদিন হারার জ্বলুনিটা বাংলাদেশের এখনও যায়নি। বাংলাদেশিরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন সে দিন আইসিসির চেয়ারম্যান শ্রীনিবাসনই আম্পায়ারদের ম্যানেজ করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের জেতার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ফলে দেশের মাটিতে ওয়ান ডে সিরিজ জেতার পর তাদের সেই রাগের চিড়বিড়ানিটাই এখন অন্যভাবে বেরোচ্ছে!’

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ক্রিকেট সাংবাদিক দাক্শ পানোয়ার এবারে দেবাশিস দত্তের সঙ্গে পুরোপুরি একমত তা বলা যাবে না। কিন্তু তিনিও বলছেন ক্রিকেটকে ঘিরে ভারত-বাংলাদেশের রেষারেষিটা এমন জায়গায় চলে গেছে যে দুপক্ষের কেউই আর সেখানে রুচি, শালীনতা বা ভব্যতা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না! তার মতে, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে রাজনীতি থেকে খেলা, নানা ক্ষেত্রে নানা সমস্যা আছে– ক্রিকেটেই তার প্রতিফলনটা হচ্ছে সবচেয়ে দৃষ্টিকটূভাবে।

আসলে ক্রিকেট নিয়ে এমন খোঁচা দেওয়া বিজ্ঞাপন তো এটাই প্রথম নয়। বিশ্বকাপের আগে ভারতের মওকা মওকা সিরিজের বিজ্ঞাপন নিয়ে কেমন তুলকালাম হয়েছিল, সেই স্মৃতি তো এখনও টাটকা। সদ্যসমাপ্ত বাংলাদেশ সফরের আগে বাংলাদেশকে ক্রিকেট দুনিয়ার ‘বাচ্চা’ বলে ঠাট্টা করে বানানো ভারতের একটি বিজ্ঞাপন নিয়ে তো ঢাকায় এম এস ধোনিকে সাংবাদিক বৈঠকেও প্রশ্ন করা হয়েছিল। ধোনি হাসতে হাসতে জবাব দেন, ‘আমরা তো আর বিজ্ঞাপনটা বানাইনি!’

খোঁচা দেওয়ার ইতিহাসে বাংলাদেশও অবশ্য ভালই হাত পাকিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে ভারতের মওকা মওকা-র যতগুলো জবাবি ভিডিও বাংলাদেশে তৈরি হয়েছিল তা গুনে শেষ করা মুশকিল। তারপর জুনে ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজ চলাকালীন বাংলাদেশের টেলিভিশনে মোটা বাঁশের ডান্ডা দিয়ে ‘ব্যাম্বু ইজ অন’ বিজ্ঞাপনের কথাও নিশ্চয় অনেকেরই মনে আছে। ভারতের ওয়ান ডে ক্যাপ্টেন ভিরাট কোহলিকে সেই ব্যাম্বু নিয়ে প্রশ্ন করা হলে রীতিমতো অস্বস্তির সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘এটা তো একটা অ্যাড ক্যাম্পেইন, কী আর বলব বলুন?’

তবে এখন যে বিজ্ঞাপনটা নিয়ে নতুন করে আবার হইচই শুরু হয়েছে, সেই ‘মুস্তাফিজ কাটার’ নিয়ে ভারতে রসিকতা উপভোগ করার লোকেরও কিন্তু অভাব নেই। ভারতের অ্যাডভার্টাইজিং জগতের দিকপাল প্রহ্লাদ কক্কর যেমন এই বিজ্ঞাপনের ‘লাইটার সাইড’ বা হালকা দিকটা দেখতে ভুল করছেন না– এবং তার মতে এটায় দারুণ ক্রিয়েটিভিটি বা সৃষ্টিশীলতারও ছাপ আছে!

অ্যাড গুরু কক্কর যে কথাটা বলছেন সেটা মারাত্মক, ‘এই বিজ্ঞাপনটা যদি ভারতীয় ক্রিকেটারদের বদলে ধরা যাক অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে বানানো হত, তাহলে আমরা তো দিব্বি উপভোগ করতাম। আর যদি পাকিস্তানকে নিয়ে বানানো হত তাহলে তো কথাই নেই, নির্ঘাত আমরা দ্বিগুণ হাসতাম!’

কিন্তু মুশকিল হল– ভারতে ক্রিকেটারদের যে প্রায় দেবতার মতো সম্মান, সেখানে তাদের নিয়ে হাসাহাসি করাটাও যে গর্হিত অপরাধ!