কলসিন্দুর থেকে এতদূর আসার গল্প মারিয়ার
কলসিন্দুর থেকে এতদূর আসার গল্প মারিয়ার
বাবা বীরেন্দ্র মারাত মারা গেছেন। মা এনোতা মান্দা ক্ষেতমজুরের কাজ করেন। তিন মেয়ে, এক ছেলে। দেশের মেয়েদের ফুটবলের আতুরঘর কলসিন্দুরের হতদরিদ্র এই পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। সেই পরিবারের খ্যাতি এখন দেশজোড়া। মারিয়া মান্দার হাত ধরে এসেছে মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা। দেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক কোনো মহিলা ফুটবলের প্রথম ট্রুফি জয় বাংলাদেশের।
দেশজুড়ে এখন নাম অধিনায়ক মারিয়ার। অথচ পাঁচ বছর আগেও মাঠে খেলতে যাওয়ার সময় গ্রামের মহিলারা বাঁকা চোখে তাকাতেন। অনেকেই বলতেন, মেয়েরা আবার ফুটবল খেলে নাকি?’ বোনেরা বলত, খেলার কারণেই পড়ালেখাটা হবে না মারিয়ার। অনেক বাধা পেরিয়ে আজ এ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে মারিয়া। তার কথায়, ‘ময়মনসিংহের কলসিন্দুরে বাড়ি আমাদের। গ্রামের মানুষ আমাদেরকে খেলতে দেখলেই নাক সিটকাতো। বোনেরাও খেলতে নিষেধ করত। কিন্তু এখন সবাই আমাকে সাপোর্ট করে। খেলতে উৎসাহ দেয়।’ উঠে আসার গল্প শোনায় মারিয়া, ‘২০১১ সালে প্রথমবার কলসিন্দুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হয়ে বঙ্গমাতা ফুটবলে খেলি। সেই থেকেই প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল শুরু। পরের বছর খেলতে এসেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারিনি। তবে ২০১৩ সালে শিরোপা নিয়েই বাড়ি ফিরি। ওই ট্রুফিই আমার জীবন বদলে দিয়েছে।’ সে যোগ করে, ‘এরপর বিভাগে খেলার জন্য ডাক পাই। সেখান থেকে জাতীয় দলের ক্যাম্পে। এভাবেই এখন আমি মারিয়া।’
২০১৪ সালে মারিয়ার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু। ওই বছর নেপালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক পর্বে দুর্দান্ত খেলে ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৪ দল। ওই দলের অন্যতম সদস্য মারিয়া। তার কথায়, ‘নেপালে আমার প্রথম বিদেশে খেলতে যাওয়া। ফাইনালে খেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ঠিক ওই সময় ২৫ এপ্রিল ভয়াবহ ভূমিকম্প হয় সেখানে। আমরা প্রাণে বেঁচে ফিরে আসি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহায়তায়। পরে নেপালেই ফাইনাল হয়েছে। আমরা ট্রুফি জিতে দেশে ফিরি। পরের বছরও এই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। আর এবার সাফের অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবলের ট্রুফি জিতলাম।’
এই মিডফিল্ডারের লক্ষ্য, ‘দেশকে ট্রুফি উপহার দিতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। আমরা ভীষণ আনন্দিত। এখন আমার লক্ষ্য জাতীয় দলে খেলা। মেসি এবং রোনাল্ডোকে যেমন মানুষ চেনে, আমাকেও যেন সেভাবে সবাই চেনে, এটাই চাই। এজন্য আমাকে আরও পরিশ্রম করতে হবে।’
ফুটবল খেলে পরিবারকে সহায়তা করেন মারিয়া। ২০০৩ সালে জন্ম নেয়া মারিয়ার কথায়, ‘মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মায়ের টাকায় মেজো বোন আর ছোট ভাইয়ের খরচ চলে না। মাকে কিছু টাকা পাঠাই। সভাপতি স্যার (বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন) বলেছেন, আগামী বছর আমাদের জন্য পেশাদার লীগ চালু করবেন। যদি চালু হয়, তাহলে আমরা আরও টাকা পাব। ছোট ভাইকে পড়াশোনা করাতে পারব। আমি চাই ও পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াক।’ দশম শ্রেণীর ছাত্রী মারিয়ার শেষ কথা, ‘আপনেরা সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি যেন নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারি।’