স্কুল পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থীর পেছনে পরিবারের যে পরিমাণ ব্যয় হয় তার ৭৫ শতাংশেরও বেশি যায় কোচিংয়ের পেছনে। আর এই অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন স্কুলগুলোরই এক শ্রেণির শিক্ষক।

স্কুলের সময়টুকু বাদে সকাল-সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ সময় কাটে কোচিংয়ের পেছনে দৌড়ে। আর তাদের আনা-নেওয়া করতে করতে কাহিল অভিভাবকরা।

রাজধানীর গুলশান-২-এর থ্রিজি কোচিং সেন্টার, লালমাটিয়ার লিজেন্ড কোচিং সেন্টার, বনানীতে এডুকেশন, নিকেতনে সারভাইভ এবং মিরপুর, ধানমণ্ডি, মতিঝিল, ফার্মগেট, উত্তরার একাধিক কোচিং সেন্টারে পড়তে আসা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব কোচিংয়ে ক্লাস চলে সকাল ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত।

গুলশান এলাকায় একটি কোচিং সেন্টারে গণিতের এক শিক্ষক নবম শ্রেণির তিনটি, দশম শ্রেণির তিনটি ও ‘এ’ লেভেলের তিনটি ব্যাচে শিক্ষার্থী পড়ান। প্রতি ব্যাচে গড়ে ৮০ থেকে ১০০ জন পড়ে। নবম ও দশম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে চার হাজার ও ‘এ’ লেভেলের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা নেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে আবার বুকিং মানি নেওয়া হয় এক হাজার টাকা। একটি ব্যাচের ক্লাস হয় সপ্তাহে তিন দিন। প্রতি ক্লাস দুই ঘণ্টার। ওই শিক্ষকের মাসিক আয় মাসে ৩০ লাখ টাকার বেশি।

রাজধানীর উত্তরা আর বনানীতে সপ্তাহে সাত দিনই সকাল ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত রসায়ন পড়ান আরেক শিক্ষক। ‘ও’ লেভেল, ‘এ’ লেভেল এবং নবম-দশম শ্রেণির ২২টি ব্যাচ। প্রতি ব্যাচে ৪০ থেকে ৪৫ জন শিক্ষার্থী। প্রতিদিন দেড় ঘণ্টা হিসাবে প্রতি ব্যাচের ক্লাস নেন সপ্তাহে দুই দিন। শিক্ষার্থীপ্রতি নেন তিন হাজার টাকা। এ ছাড়া পরীক্ষার প্রস্তুতি, ল্যাব ক্লাসের জন্য মাসে জনপ্রতি নেন ছয় হাজার টাকা করে। ওই শিক্ষকের মাসিক আয় ৪২ লাখ টাকার বেশি। এই অবস্থা নামিদামি কোচিং সেন্টারগুলোর প্রায় প্রত্যেক শিক্ষকের।

কোচিংয়ের খরচ জোগাতে অনেক সময় গয়না কিংবা সম্পদও বিক্রি করতে হয়। ধারদেনা তো আছেই। রাফিত রাজধানীর মিরপুর এলাকার একটি নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের নবম শ্রেণিতে পড়ে। মাস গেলে স্কুলে বেতন দিতে হয় ১৬ হাজার ২০০ টাকা। বাংলা, ইংরেজি, পর্দাথবিজ্ঞান, রসায়ন, অঙ্কসহ আট বিষয়ে কোচিং করে সে। বাসা রাজধানীর মগবাজারে। তার কোচিংগুলো গুলশান, লালমাটিয়া, ধানমণ্ডি বা উত্তরা এলাকায়। স্কুল শেষে কোনো দিন ছুটতে হয় লালমাটিয়া, কোনো দিন ধানমণ্ডি, গুলশান কিংবা উত্তরায়। সকাল সাড়ে ৬টায় বের হয়ে দুপুর ২টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত স্কুল; তারপর কোচিং শেষে রাত ১০টা-১১টার আগে সে বাসায় ফিরতে পারে না।

শুক্র-শনিবার অবস্থা আরো কাহিল। ভোর ৭টায় শুরু হয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি। প্রতি বিষয়ে সপ্তাহে দুই দিন ক্লাস। সময় এক থেকে বড়জোর দেড় ঘণ্টা। এ জন্য মাসে বাংলা, ইংরেজিতে তিন হাজার টাকা এবং অন্য বিষয়ের জন্য চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে দিতে হয়। প্রতি মাসে শুধু কোচিং বাবদ খরচ হয় ৩২ হাজার টাকা।

রাফিতদের ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। স্কুল ও কোচিংয়ে আসা-যাওয়া করতে হয় রিকশা কিংবা সিএনজি অটোরিকশায়। এতেও প্রায় ১৭ হাজার টাকা খরচ হয়। আবার কোচিংয়ের স্যারদের সুপারিশে আর স্কুলের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী রাফিতের জন্য বই কিনতে হয়েছে প্রায় ২১ হাজার টাকার। কোচিংয়ের ফাঁকে নাস্তা ও স্কুলের টিফিন বাবদ সপ্তাহে লাগে গড়ে এক থেকে দেড় হাজার টাকা। খাতা-কলমসহ অন্যান্য খাতেও এক-দেড় হাজার টাকা লাগে। পড়াশোনা খাতে তার পেছনে মাসে পরিবারের ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৬৮ হাজার টাকা।

স্কুল আর কোচিংয়ের ছোটাছুটিতে রাফিতের সঙ্গে থাকে তার মা। সাপ্তাহিক ছুটির দুই দিনে কখনো কখনো বাবাও থাকেন। নবম শ্রেণিতে ওঠার পর রাফিতের একটি দিনও পরিবারের সঙ্গে বাসায় দুপুরের খাবার বা বিকেলের নাস্তা খাওয়া হয়নি। ছোট বোন আড়াই বছরের আলোর সঙ্গে দেখা হয় না বললেই চলে। কোনো স্বজনের বাসায়ও যাওয়া হয় না।

পড়ার খরচে পিছিয়ে নেই বাংলা মাধ্যমী। রাজধানীর মতিঝিলের নামি একটি স্কুলের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর বাবা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্কুলের বেতন এক হাজার টাকা হলেও নানা ফি মিলিয়ে মাসে দিতে হয় ছয় হাজার টাকা। আবার স্কুলের শিক্ষকদের কাছেই কোচিংয়ে প্রতি বিষয়ের জন্য দুই থেকে আড়াই-তিন হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। এর বাইরে অনেক সময়ই স্কুলে একটি বিষয় একাধিক শিক্ষক পড়িয়ে থাকলে তাদের প্রত্যেকের কাছেই কোচিং করাতে হয়। না হলে বিভিন্ন অজুহাত তুলে পরীক্ষার খাতায় নম্বর কম দেয়। কোচিংয়ের পেছনেই মাসে যাচ্ছে ২৪ হাজার টাকা। স্কুলের বেতন কোচিং ফি যাতায়াতসহ পড়ালেখা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতে মাসে ব্যয় করতে হয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা।

ওই অভিভাবক শিল্প মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতি মাসেই ধার-দেনা করছি। খরচ না করে তো উপায় নেই! ভোরে বাচ্চাকে নিয়ে স্ত্রী বের হয়ে যায়। আমি সকালের নাস্তা বাসার সামনের দোকানে সারি। অফিসে দুপুরের খাবার দোকান থেকে আনিয়ে খাই। অফিস শেষ করে সোজা কোচিংয়ে চলে যাই। এরপর আমার স্ত্রী বাসায় যান। জীবন বলে কিছু নেই। মেয়েকে নিয়ে ফিরি রাত সাড়ে ১০টায়। ’

বেশির ভাগ কোচিং সেন্টারে অভিভাবকদের জন্য বসার ব্যবস্থাও নেই। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। টুল নিয়ে কোচিংয়ের সামনে বসে থাকেন মায়েরা। ছুটির দিনেও রেহাই নেই—সে দিনও কোচিংয়ে আসতে হয়।

এ কেমন পড়াশোনা : বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ধনী লোকেরাও দেশের পড়ালেখায় অসুস্থ নিয়মকানুনে হিমশিম খাচ্ছে। উচ্চ, মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্ত শ্রেণিও ভয়ানক সমস্যায় পড়ছে কোচিংনির্ভর পড়ালেখায়। আমি অনেক পরিবারকে চিনি, যারা শুধু সন্তানের এসএসসি বা ও লেভেল পরীক্ষা শেষ করাতে স্ত্রীর গহনা, জমি বিক্রি করে দিয়েছে। অথচ শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে মনোযোগ দিয়ে পড়ালেই শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের এ হয়রানি হতো না। ’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, শিক্ষক নামধারী কিছু মানুষ কোমলমতি শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারকে জিম্মি করে অর্থ লুটে নিচ্ছে। সন্তানের ভালো হচ্ছে মনে করে বাবা-মা সব কিছুর বিনিময়ে কোচিংয়ে ছুটছে। এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা থামাতে সরকারকেই কঠোর হতে হবে।

সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে অনেক কোচিং সেন্টারে অভিযান চালিয়ে শিক্ষকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আয় সম্পর্কে তথ্য-প্রমাণ খতিয়ে দেখছে। অভিযোগ পাওয়া যায়, এসব শিক্ষকের  বেশির ভাগই আয়কর রিটার্নে প্রকৃত আয় গোপন করে নামমাত্র কিছু কর পরিশোধ করছেন।

এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, স্কুলের শিক্ষক হয়েও  স্কুলে না পড়িয়ে বাইরে পড়ালেখা শেখানোর নামে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে কোচিংয়ের ব্যবসা করছেন। শিক্ষার্থীদের পরিবারকে আর্থিকভাবে শেষ করে দিচ্ছেন। অথচ আয়কর রিটার্নে এসব আয় গোপন করছেন শিক্ষকরা। কোচিং সেন্টারে কাঁরা কত টাকা আয় করছেন, তা নিয়ে জোরেশোরে কাজ শুরু করবে এনবিআর। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও শিক্ষা বিষয়ক বেসরকারি মোর্চা গণ-সাক্ষরতার নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ কেমন পড়াশোনা! আসলে বাচ্চারা কী শিখছে? আমরা তাদের পরীক্ষার্থী বানিয়ে ফেলছি। এসএসসি দেওয়ার আগে দুবার বড় ধরনের পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে তাদের। এ ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। স্কুলে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। কোচিং সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করতে হবে। ’

ভাঙছে পারিবারিক বন্ধন : স্কুল-কোচিংয়ে দৌড়াদৌড়িতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের পারবারিক জীবন ভেঙে পড়ছে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ব্যাগভর্তি বইয়ের বোঝা কাঁধে নিয়ে সকালে বের হয়, ফেরে রাতে। সঙ্গে থাকা অভিভাবকেরও একই অবস্থা।

অনেক সময় কঠোর পরিশ্রমের পরও শিক্ষার্থী ভালো ফল করতে না পারায় মা-বাবা কিংবা পরিবারের অনেকে তাদের তিরস্কার করে। তার চেয়ে ভালো ফল করা কাছের সহপাঠীর উদাহরণ টেনে বিভিন্ন উপদেশ দেয়, দুর্ব্যবহার করে। এমন ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে, তাদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। এতে সামাজিক অবক্ষয়ের ঝুঁকিও বাড়ছে।

খুলনার একটি সরকারি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির সাপ্তাহিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল সাদিয়া। বাসায় ফেরার পর মা বকাঝকা করেন। বাবাও কটু কথা বলেন। ওই রাতে কিছু খায়নি সাদিয়া। সকালে ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে তার ঝুলন্ত মৃতদেহ পাওয়া যায়। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা চিরকুটে রেখা ছিল, ‘সেই ছোট্ট থেকে স্কুল করছি, কোচিং করছি, বাসায় টিচারের কাছে পড়ছি। শুধু তুমি চাও বলেই মা আমি সারাক্ষণ পড়ি। কিন্তু মাঝে মাঝে হায়েস্ট না পেলে আমি কী করব। আমার এত পড়তে ভাল লাগে না। তুমি আর বাবা আমাকে বকা দাও। কষ্ট লাগে। আমি বাথরুমে গিয়ে কাঁদি। খুব মন খারাপ হয়। মা আমি আর পারছি না। তাই চলে যাচ্ছি। ’

সন্তানের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে মা-বাবাও কাহিল। থ্রিজি কোচিংয়ে মেয়েকে নিয়ে আসা রত্না বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, ভোরে বের হই। ফিরতে রাত ১১টা।   স্বামীর সঙ্গে একবার সকালে বের হওয়ার সময় আরেকবার সেই রাতে দেখা হয়। বৃদ্ধ শ্বশুর বাসায় একাই থাকেন।

বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের মাসসিক রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সালাউদ্দিন কাউসার কালের কণ্ঠকে বলেন, সারা দিন স্কুল-কোচিংয়ের পেছনে ছোটায় অনেকে পারিবারিক জীবন থেকে ক্রমেই দূরে সরে  যাচ্ছে। পরিবারের একে অন্যের অনভূতি ভাগাভাগি করে নেওয়ার সময়-সুযোগ পাচ্ছে না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবারের ওপর।