যমুনায় পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে
যমুনায় পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে
পানি হ্রস পেয়ে তিস্তা ও সুরমা অববাহিকায় কিছুটা বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও যমুনায় পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে যমুনার পানি বৃদ্ধিতে শত বর্ষের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বলে জানিয়েছেন সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী রয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। জামালপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামে বিচ্ছিন্ন রয়েছে রেল যোগাযোগ। তবে বন্যা কবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। জামালপুরে বন্যার পানিতে মারা গেছে এক কলেজ ছাত্র। ব্যুরো অফিস, প্রতিনিধি ও সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর-
সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে অস্বাভাবিকভাবে পানি বাড়ছে। গত ২৪  ঘণ্টায় পানি ১৬ সেন্টিমিটার  বৃদ্ধি পেয়ে  বিপদ সীমার ১২৮  সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে । কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালি, শাহজাদপুর ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার দুইশ’ ৫৬ টি  গ্রাম বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে । সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম জানান  যমুনার পানি বৃদ্ধি একশ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে । জেলার মোট ৭৮ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৬/৭ কিলোমিটার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে । সেনাবাহিনী মেরামতকৃত বাধ এলাকায় কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছে ।
জামালপুর: জেলার ৬৬ ইউনিয়নের মধ্যে প্রায় ৪০টি ইউনিয়ন এবং ৫টি পৌরসভা বন্যা কবলিত হয়ে প্রায় ৪ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ৩শ র’অধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। জেলার মেলান্দহের দুরমুঠ এবং ইসলামপুর বুরুঙ্গী রেল লাইন পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জামালপুর থেকে দেওয়ানগঞ্জ পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। সরিষাবাড়ীতে তারাকান্দি-বঙ্গবন্ধু সেতুর সংযোগ সড়ক হুমকির মুখে পড়ায় সেনা সদস্যরা সড়ককটি  রক্ষায় কাজ করছে। দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার সাথে সড়ক যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে ১০ সে.মিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদ সীমার ১৩৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল বলে জানিয়েছে পাউবো সূত্র। মাদারগঞ্জে চাঁদপুর-নাংলা নাদাগারী অংশে যমুনা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে কমল (১৭) নামে এক কলেজ ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। কমল ইসলামপুর ডিগ্রি কলেজের ছাত্র। ইসলামপুরে সরকারি হিসাব অনুযয়ী ২১০টি আধাপাকা ঘর বন্যার পানিতে নিশ্চিহ্নি হয়েছে। বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণের জন্য চলছে হাহাকার।
দিনাজপুর: জেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তীত রয়েছে। জেলার ১৬টি নদীর পানি গতকালও বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দিনাজপুরের সাথে সারাদেশের রেল যোগাযোগ চালু হয়নি। বিরলে গতকাল বন্যাজনিত কারণে আরো একজনের মৃত্যু হয়েছে। এনিয়ে জেলায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৬ জনে। জেলা সদরের সাথে ১১টি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সেনাবাহিনীর দুইশ সদস্য দিনাজপুর শহররক্ষা বাঁধ মেরামতে কাজ করছে। জেলার প্রায় ৫ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
লালমনিরহাট: গতকালও জেলার ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ১০০ সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ৫টি উপজেলার লক্ষাধিক পরিবার পানিবন্দী। সদর উপজেলার ধরলা নদীর তীরবর্তী ৪টি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। রেল যোগাযোগ গতকালও স্বাভাবিক হয়নি। ২৬ হাজার হেক্টর ফসলি জমি ও প্রায় ৫ হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। তিনটি সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিম জেলায় কাজ করছে। এপর্যন্ত জেলায় বন্যাজনিত কারণে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে।
জয়পুরহাট: জেলা সদরের সাত ইউনিয়নে ও পাঁচবিবি উপজেলায় গতকাল নতুন কিছু এলাকা  প্লাবিত হয়েছে। প্রায় তিন হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন তলিয়ে গেছে। কয়েক হাজার মানুষ বানিবন্দী রয়েছে।
মানিকগঞ্জ:শিবালয় উপজেলার আরিচাঘাট পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি বিপদ সীমার ৩৭ সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদী তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চলের ফসলি জমিসহ নতুন নতুন এলাকা।
বগুড়া: গত ২৪ ঘণ্টায় সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনার পানি ২৯ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ১১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ।  বন্যা নিয়ন্ত্রর বাঁধের বেশকিছু স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। সারিয়কান্দি, সোনাতলা ও ধুনটের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। প্রায় ২ হাজার ৭শ’ পরিবার বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস জানায়, প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ৬৬টি  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করেছে।
পঞ্চগড়: জেলার আশ্রয় কেন্দ্রগুলো থেকে লোকজন বাড়ি ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ আর উজানের পনিতে জেলায় কয়েক শতাধিক রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ কালর্ভাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও রেলপথের প্রায় ২ কিলোমিটার রেলপথ সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে।
নেত্রকোনা:জেলার ৮টি উপজেলায় প্লাবিত আটশ’ গ্রামে অন্তত দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। দুর্গাপুৃর, কলমাকান্দা উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ভেসে গেছে কয়েক হাজার পুকুরের মাছ। চরম খাদ্য সংকটে পরেছে গবাদি পশু। বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে জেলার কংস, ধনু, উব্দাখালিসহ সব ক’টা নদীর পানি। জেলায় ৯৮ টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
কুড়িগ্রাম:কুড়িগ্রামে ধরলার পানি সামান্য হ্রাস পেলেও ব্রহ্মপুত্রের পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। গতকাল চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বেড়ে বিপদসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে এবং সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপদসীমার ১০১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পানিবন্দি রয়েছে জেলার ৯ উপজেলার ৫৯টি ইউনিয়নের প্রায় ৪ লক্ষাধিক মানুষ। এ পর্যন্ত বন্যায় আট জনের মৃত্যু হয়েছে এবং নিঁখোজ রয়েছে আরো দুইজন।  ভূরুঙ্গামারী-সোনাহাট স্থল বন্দরের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। কুড়িগ্রাম-নাগেশ্বরী পাকা সড়কের কয়েকটি স্থান ভেঙ্গে ও পানি প্রবাহিত হওয়ায় বিচ্ছিন্ন রয়েছে সড়ক যোগাযোগ। কুড়িগ্রামের টগরাইহাটে রেলওয়ে সেতুর গার্ডার ধসে যাওয়ায় রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। তলিয়ে গেছে ৫০ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন ক্ষেত। ত্রান তত্পরতা চললেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
সিলেট: সুনামগঞ্জ শহরের সুরমার পানি হ্রাস পেলেও গতকাল বিপদ সীমার ৪৪ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গোয়াইনঘাট উপজেলার প্রায় আড়াই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়। এই উপজেলার সঙ্গে সিলেট শহরের যোগাযোগের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পঁচে গেছে ধানের চারা। শাল্লা, দিরাই, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার, জগন্নাথপুর উপজেলায় বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
 ঠাকুরগাঁও: জেলার নদ-নদীর পানি কমে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে নিচু এলাকা থেকে পানি এখনো না সরে যাওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্র গুলোতে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ অবস্থান করছে। এছাড়াও বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে। তিনদিন আগে নিখোঁজ হওয়া রিয়াদ (২০) নামে এক কলেজ শিক্ষার্থীর লাশ গতকাল টাঙ্গন নদীতে ভেসে ওঠে। এখনো নিখোঁজ আছে ৩ শিশু। পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরের সাথে রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। পাঁচ উপজেলায় পানির নিচে ৫ হাজার হেক্টর জমি  রয়েছে।
নওগাঁ:আত্রাই নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ১৪টি স্থানে ভেঙে গেছে। এরমধ্যে মান্দায় ৬টি, রানীনগর ৫টি, আত্রাইয়ে ২টি ও পত্নীতলায় ১টি রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় প্রায় শতাধিক ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। ক্ষতিগ্রস্তরা আকাশের নিচে বাস করছে। জেলার ছয় উপজেলায় তলিয়ে গেছে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি। প্রায় দুই লাখ লোক পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণ খুবই অপ্রতুল। ছোট যমুন নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নওগাঁ শহর রক্ষা বাঁধ উপচে নওগাঁ শহরের বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত। ধামইরহাটে আত্রাই নদীতে ২০০ সেন্টিমিটার, পত্নীতলায় ২২০ সেন্টিমিটার, মান্দায় ১১১ সেন্টিমিটার বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি ও গো খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। জেলায় প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে।
নীলফামারী: পানির তোড়ে ভেঙে যাওয়া সৈয়দপুর শহর রক্ষা বাঁধের ভাঙন গতকালও রোধ করা সম্ভব না হওয়ায় উপজেলার নতুন নতুন এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা ভাঙণ রোধে গতকালও বিরামহীন ভাবে কাজ করে চলেছেন। পানির চাপে সৈয়দপুর বিমান বন্দরের সীমানা প্রাচীর ধসে পড়েছে। সৈয়দপুর ১০০ শয্যা হাসপাতালের নিচতলায় পানি ঢুকে পড়ায় বন্ধ হয়ে গেছে বিদ্যুত্ সরবরাহ। প্রায় বন্ধ রয়েছে সিকিত্সা সেবাও।
রংপুর: পানি কমায় তিস্তার চরাঞ্চলে বেড়েছে ভাঙ্গনের তীব্রতাও। এর মধ্যে গংগাচড়ায় বিভিন্ন এলাকায় ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দিরসহ প্রায় সাড়ে ৪’শ ঘরবাড়ি। এছাড়াও তিস্তার চরাঞ্চলের এখনো প্রায় ৫০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে রয়েছে। পানিবন্দি মানুষগুলোর মাঝে দেখা দিয়ে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের তীব্র সংকট।
গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী): গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মার পানি গতকাল মঙ্গলবার বিপদ সীমার ৫২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চারটি ইউনিয়নের প্রায় ৮৮টি গ্রাম বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। ৬৩ হাজার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।
ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল): ভূঞাপুরে যমুনা নদীতে বিপদসীমার ১২৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।  উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। তারাকান্দি-টাঙ্গাইল সড়ক লিকেজ হয়ে কমপক্ষে ১০ পয়েন্ট দিয়ে পানি প্রবেশ করছে।
সুত্র : ইত্তেফাক