চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে পাঁচটি সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে এশিয়া-ইউরোপ-আমেরিকায় পণ্য আনা-নেওয়া করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে সিঙ্গাপুর বন্দর, আর দ্বিতীয় স্থানে আছে শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দর। ইদানীং পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কলম্বো বন্দর।
শিপিং লাইনগুলো বলছে, গভীর সমুদ্রবন্দর, মাদার ভেসেলের (বড় জাহাজ) মাধ্যমে কানেকটিভিটি সহজ হয়ে ওঠা এবং সময় সাশ্রয়ী হওয়ায় কলম্বো বন্দরের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাক শিল্প মালিক ও ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম চট্টগ্রামের প্রেসিডেন্ট এস এম আবু তৈয়ব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রপ্তানি পণ্য কোন লাইন ও কোন বন্দর দিয়ে যাবে তা ঠিক করে বিদেশি ক্রেতারা। তারা কলম্বো বন্দরকে বেছে নিচ্ছে কারণ সেই বন্দরে ট্যারিফ কম। আর কানেকটিভিটিও ভালো। টাইমিংয়ে খুব সমস্যা না হলে তারা সিঙ্গাপুর বন্দর ব্যবহার করছে না। ’
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য পেতে কলম্বো বন্দরও নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করে সুযোগ-সুবিধা আরো বাড়াচ্ছে। ফলে এই জনপ্রিয়তা আরো বাড়বে বলে মন্তব্য করে আবু তৈয়ব বলেন, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হলে সুযোগ-সুবিধা এখনকার চেয়ে অনেক বেশি বাড়বে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৫৭টি ফিডার জাহাজের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি পণ্য কনটেইনারে পরিবহন করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩টি জাহাজ চলে সিঙ্গাপুরভিত্তিক মায়ের্কস গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এমসিসি লাইনের। বর্তমানে রপ্তানিপণ্যের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ চট্টগ্রাম-কলম্বো রুট দিয়ে পরিবহন করছে এ শিপিং লাইন।
জানতে চাইলে মায়ের্কস লাইন বাংলাদেশের সারোয়ার আলম চৌধুরী বলেন, এটা আমাদের ওপর নির্ভর করে না। বিদেশি শিপিং লাইনগুলো নিজেরা একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের কানেকটিভিটি কোনটা ভালো ও সহজ সেটি বিবেচনা করেই পণ্য পরিবহন করে থাকি। ইদানীং পণ্য রপ্তানিতে কলম্বো বন্দরের মাধ্যমে ৭০ শতাংশ পণ্য পরিবহন এটাই কারণ। আমাদের জাহাজের সঙ্গে কলম্বোর কানেকটিভিটি বেশ ভালো।
শিপিং কম্পানিগুলো জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার সরাসরি ইউরোপ-আমেরিকায় যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রপ্তানি পণ্যের কনটেইনার নিয়ে ছোট বা ফিডার জাহাজে করে সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কার কলম্বো, মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং ও তানজুম পেলিপাস-প্রধানত এই চার বন্দরে পৌঁছে। বন্দরে নামানোর পর সেই চার বন্দর থেকে কনটেইনারগুলো বড় কনটেইনার জাহাজ বা মাদার ভেসেলে করে বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে পৌঁছানো হয়। আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রেও একই রকম পদ্ধতি। এই চার বন্দরের মাধ্যমে চট্টগ্রামে পৌঁছে। চট্টগ্রাম বন্দরে সাড়ে ৯ মিটারের চেয়ে বড় জাহাজ ভেড়ার সুযোগ না থাকায় এই পদ্ধতি (ট্রান্সশিপমেন্ট) অনুসরণ করতে হয়।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটে আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি জাহাজ চলাচল করছে। জাহাজ পরিচালনাকারী কম্পানিগুলো জোট বেঁধে (অ্যালায়েন্স) কলম্বো রুটে পণ্য পরিবহন করছে। উদাহরণ দিয়ে বিদেশি মেডিটারিয়ান শিপিং লাইনসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক আজমীর হোসাইন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কলম্বো বন্দর থেকে ইউরোপের বেলজিয়াম বন্দরে পৌঁছতে লাগছে ১৫ দিন আর সিঙ্গাপুর হয়ে গেলে লাগছে ২০-২১ দিন। এই পাঁচ-ছয় দিন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বাড়তি সময় ধরে রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে সময় দিতে পারছেন। ’
তিনি বলছেন, সময় সাশ্রয় ছাড়াও কলম্বো বন্দরের ট্যারিফ সিঙ্গাপুরের চেয়ে ৫০ শতাংশ কম। আর কোনো কারণে মাদার ভেসেল সংযোগ ব্যর্থ হলে কলম্বো ও সিঙ্গাপুরে একই সময় লাগছে। ফলে কলম্বোর দিকেই ঝোঁক বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য পরিবহনে।
জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থার হিসাবে, ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা-যাওয়া আমদানি-রপ্তানি কনটেইনারের মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ এসেছে সিঙ্গাপুর বন্দরের মাধ্যমে, আর ২৬ শতাংশের বেশি এসেছে কলম্বো বন্দর, ২৬ শতাংশ এসেছে মালয়েশিয়ার দুটি বন্দর পোর্ট কেলাং ও তানজুম পেলিপাসের মাধ্যমে। এ ছাড়া ইদানীং সামান্য কিছু কনটেইনার ভারতের কলকাতা বন্দরের মাধ্যমে হচ্ছে।
গত ১৩ জুলাই তিন দিনের সফরে বাংলাদেশ আসেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইত্রিপালা সিরিসেনা। গত ১৪ জুলাই শুক্রবার দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ২০১৭ সালের মধ্যেই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে একমত হয়েছেন। এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার নৌ কানেকটিভিটি আরো অনেক বেড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, উপকূলীয় জাহাজ চলাচলে সমঝোতা স্মারক সইয়ের ফলে বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথের বদলে উপকূল দিয়ে জাহাজ শ্রীলঙ্কার বন্দরে পৌঁছতে পারবে।
জুনিয়র চেম্বার চিটাগংয়ের প্রেসিডেন্ট গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বিষয়টি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বহুগুণ বাড়বে। উপকূলীয় জাহাজ চলাচলে সমঝোতা স্মারক সইয়ের ফলে ছোট জাহাজে পণ্য পরিবহনে প্রচুর সময় সাশ্রয় হবে, খরচও অনেক কমে যাবে। যাতে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা ব্যাপকভাবে লাভবান হবেন। ’