যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। অর্থাৎ নির্ধারিত মেয়াদের এক-চতুর্থাংশ পার করলেন তিনি। নির্বাচনী প্রচারকালে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি নিয়ে দেশ পুনর্গঠনের যে অঙ্গীকার ট্রাম্প করেছিলেন, তাতে কতটা সফল বা ব্যর্থ হয়েছেন অথবা ঠিক কোন পথে তিনি রয়েছেন, তা নিয়ে শুরু হয়ে গেছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। দেখে নেওয়া যাক জাতীয়-আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি কতটা পরিবর্তন আনতে পেরেছেন।
অভিবাসন
শুরুতে দুইবার ট্রাম্পের উদ্যোগ আদালতের নির্দেশে আটকে গেলেও শেষ পর্যন্ত তিনি মুসলিমপ্রধান বেশ কয়েকটি দেশের অধিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ কঠিন করে ছেড়েছেন। এ ছাড়া শিশুকালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা প্রায় সাত লাখ মানুষের সে দেশে স্বাভাবিক জীবন যাপন নিশ্চিত করতে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেটা বাতিলেও প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প। অস্থায়ী সুরক্ষা শীর্ষক আরেকটি কর্মসূচি বাতিলের কারণে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে প্রায় দুই লাখ সালভাদোরিয়ান। ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসননীতির কারণে গত বছর অক্টোবরের শেষে এসংক্রান্ত নীতিমালায় ধরপাকড় ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়।
পরিবেশ
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বিশ্ববাসীর উদ্বেগকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া ট্রাম্প গত জুনে প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, যদিও গত সপ্তাহে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, পরিবেশবিষয়ক চুক্তি নিয়ে তাঁর আপত্তি নেই। তাঁর আপত্তিটা আসলে ওবামার আমলে করা প্যারিস চুক্তির ভাষা নিয়ে। গত এক বছরে পরিবেশ নিয়ে ৬০টি কেন্দ্রীয় নীতিমালা পরিবর্তনের চেষ্টা করে তিনি ২৯টিতে সাফল্য পেয়েছেন। পরিবেশবাদীদের উদ্বেগের কারণে যেসব জ্বালানি সরবরাহ প্রকল্প বহুদিন ধরে ঝুলে ছিল, সেগুলোতে তিনি অনুমোদন দিয়েছেন। নতুন করে জ্বালানি অনুসন্ধানের ঘোষণাও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা।
পররাষ্ট্রনীতি
‘সর্বাগ্রে আমেরিকা’ স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় বসার পর ধনাঢ্য এই রিপাবলিকান নেতা ভোটারদের কাছে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি ওই স্লোগান বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিশ্বের অন্যতম সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর উদ্দেশে তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এ জোটের জন্য অন্যায়ভাবে অনেক বেশি খরচ করছে, জোটের বাকি দেশগুলো যেন আরো বেশি অর্থ ও সামরিক শক্তি ব্যয় করে। ন্যাটোর সদস্যদের উদ্দেশে বেশ শোভন ভাষায় কথা বললেও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনকে ‘পুঁচকে রকেটম্যান’ অ্যাখ্যা দেওয়ার মতো অশিষ্টতা করেছেন ট্রাম্প। এ ছাড়া সিরিয়ায় ছুড়েছেন ৫৯টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র। ইরানের পরমাণু চুক্তি বাতিলের হুমকিও দিয়েছেন এই মার্কিন নেতা। সর্বশেষ ৬ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সব উদ্বেগ-আপত্তি উপেক্ষা করে তিনি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন, যা বিশ্বজুড়ে নিন্দিত হয়।
রুশপ্রীতির ঝঞ্ঝাট
ট্রাম্পের রাশিয়াপ্রীতি নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো মুখর থাকলেও ইউরেশীয় দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের দৃশ্যত কোনো উন্নতি হয়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারকালে ট্রাম্প রুশ-মার্কিন সম্পর্কোন্নয়নের যে অঙ্গীকার করেছেন, সেটা পূরণ করতে পারা দূরে থাক, উল্টো তাঁর বড় জামাতাসহ বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী রাশিয়ার সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ব্যুরোর (এফবিআই) তদন্তের গ্যাঁড়াকলে পড়ে গেছেন।
স্বাস্থ্যনীতি
অভিবাসন, পরিবেশ, অর্থনীতিতে ব্যাপক রদবদল করলেও ওবামাকেয়ার শীর্ষক স্বাস্থ্যনীতি বাতিলের চেষ্টায় এখনো সফল হতে পারেননি ট্রাম্প। ওবামাকেয়ারের বিকল্প সর্বজনগ্রাহ্য কোনো প্রস্তাবও তিনি সামনে আনতে পারেননি।
আদালত
সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে রিপাবলিকানরা সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার ক্ষমতার শেষ দুই বছরে নিম্ন আদালতে তাঁর মনোনীত বিচারক নিয়োগ আটকে দিয়েছিলেন। এমনিক সুপ্রিম কোর্টের একটি শূন্য আসনেও ওবামার মনোনয়ন আটকে দিয়েছিলেন তাঁরা। এ সুযোগে ট্রাম্প ইতিমধ্যে ১৮টি শূন্য পদে বিচারক নিয়োগ দিয়েছেন। তার ৪৭টি মনোনয়ন এখনো সিনেটের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে; কিন্তু খালি পড়ে আছে এখনো ১৪৯টি পদ। এসব পদ পূরণ করে বিচার বিভাগে নিজেদের দাপট প্রতিষ্ঠার সুযোগ এখনো রিপাবলিকানদের আছ। তবে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সে আশার গুড়ে বালি পড়বে।
অবকাঠামো
‘আমাদের চমৎকার দেশটাকে আমরা নতুন সড়ক, মহাসড়ক, সেতু, বিমানবন্দর, সুরঙ্গ, রেলপথ দিয়ে ভরিয়ে ফেলব’—প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হয়ে এমন ভাষণই দিয়েছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু সে ভাষণ ফাঁকা বুলির চেয়ে খুব বেশি কিছু হয়ে উঠতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ নতুনত্বের আশায় নতুন ধরনের এক প্রেসিডেন্টকে বেছে নিয়েছে। সেই প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তিনি প্রেসিডেন্সিতে আধুনিকতা আনছেন। আধুনিকতার সাক্ষ্য হিসেবে তিনি পূর্বসূরিদের রীতিনীতি ভেঙে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুরো মাত্রায় সক্রিয় থাকছেন। ট্রাম্পের সবচেয়ে অনন্য দিক হলো, তিনিই প্রথম প্রেসিডেন্ট যার সরকারব্যবস্থায় কাজ করার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, এমনকি নেই কোনো রকম সামরিক অভিজ্ঞতা। মার্কিন রাজনীতিতে পরিবর্তনের এই ধারা স্থায়ী হবে কি না, সেটা পর্যবেক্ষকরা এখনই নিশ্চিত করে বলতে পারেননি বটে, তবে রাজনীতি তাঁর জীবনাচরণে পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি বলে মনে করেন তাঁরা।
সূত্র : বিবিসি।