সৌদি আরবের পবিত্র নিদর্শন

0
1338

কাবা শরিফ : মুসলমানদের সর্বপ্রথম ইবাদতস্থল পবিত্র কাবা। রহমত ও বরকতপূর্ণ একস্থানের নাম কাবা। কাবা শরিফের উচ্চতা পূর্ব দিক থেকে ১৪ মিটার, পশ্চিম ও দক্ষিন দিক থেকে ১২.১১ মিটার এবং উত্তর দিক থেকে ১১.২৮ মিটার। এর ভেতরের মেঝে রঙ্গিন মার্বেল পাথওে তৈরি। এর সিলিংকে তিনটি কাঠের পিলার ধওে রেখেছে। প্রতিটি পিলারের ব্যাস ৪৪ সে.মি.। কাবা শরিফের দুটি সিলিং রয়েছে। এর ভেতরের দেয়ালগুলি সবুজ পর্দায় আবৃত। এই পর্দাগুলি প্রতি তিন বছর পর পর পরিবর্তন করা হয়। এর ছাদে ১২৭ সে.মি লম্বা ও ১০৪ সে.মি. প্রস্থের একটি ভেন্টিলেটর আছে যেটি দিয়ে সূর্যের আলো ভেতরে প্রবেশ করে। এটি একটি কাচ দিয়ে ঢাকা থাকে। যখন কাবা ঘরের ভেতর ধোয়া হয় তখন এই কাচটি খোলা হয়। কাবা ঘরের ভেতর প্রতি বছর দুবার ধোয়া হয়, শাবান মাসের ১৫ তারিখ এবং মহররম মাসের মাঝামঝি সময়। মেঝে ও দেয়াল গোলাপ আতর মিশ্রিত জমজমের পানি দিয়ে ধোয়া হয়। ধোয়ার পরে মেঝে এবং দেয়াল সাদা কাপড় ও টিসু দিয়ে মোছা হয়। এরপর দেয়ালগুলি পারফিউম দিয়ে সুগন্ধযুক্ত করা হয়। কাবা শরিফের কালো কাপড়ের আবরনটি প্রতি বছর ৯ জিলহজ পরিবর্তন করা হয়। কাবা শরিফকে কালো গিলাফ দ্বারা ঢেকে রাখা হয়। বর্তমানে গিলাফ কালো রেশমি কাপড় নির্মিত, যার ওপর স্বর্ণ দিযয়ে লেখা থাকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ’, ‘আল্লাহু জাল্লে জালালুহুৎ, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আজিম’ এবং ‘ইয়া হান্নান, ইয়া মান্নান’। ১৪ মিটার দীর্ঘ এবং ৯৫ সেমি প্রস্থ ৪১টি কাপড়ের টুকরা জোড়া দিয়ে গিলাফ তৈরি। এর চার কোণায় স্বর্ণ দিয়ে সুরা ইখলাস লেখা হয়। রেশমি কাপড়টির নিচে মোটা সাধারণ কাপগেরের লাইনিং থাকে। একটি গিলাফে ব্যবহৃত রেশমি কাপড়ের ওজন ৬৭০ কিলোগ্রাম এবং স্বর্ণের ওজন ১৫ কিলোগ্রাম। বর্তমানে এটি তৈরিতে ১৭ মিলিয়ন সৌদি রিয়াল ব্যয় হযয়েছে।

download

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা মোবারক : উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.)-এর কক্ষেই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাত হয় এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। মসজিদ সম্প্রসারণ করার পর বর্তমানে তাঁর কবর মোবারক মসজিদে নববীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। রাসূলে করিম (সা.)-এর রওজা মোবারকের ডানদিকে ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর কবর।

মিজাবে রহমত : বায়তুল্লাহর উত্তর দিকের ছাদে (হাতিমের মাঝ বরাবর) যে নালা বসানো আছে, তাকে ‘মিযাবে রহমত’ বলা হয় এই নালা দিয়ে ছাদের বৃষ্টির পানি পড়ে।

জমজম কূপ : দুনিয়াতে আল্লাহ রাববুল আলামিনের যত অনুপম নিদর্শন আছে, তার মধ্যে মক্কা শরিফে অবস্থিত ‘জমজম কূপ’ অন্যতম। জমজম কূপের ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা। এ কূপের পানি সর্বাধিক স্বচছ, উৎকৃষ্ট, পবিত্র ও বরকতময়। এ পানি শুধু পিপাসাই মেটায় না; এতে ক্ষুধাও নিবৃত্ত হয়। এ সম্পর্কে রাসূলে করিম (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, এ পানি শুধু পানীয় নয়; বরং খাদ্যের অংশ এবং এতে পুষ্টি রয়েছে।

মসজিদ আল কিবলাতাইন : প্রতিদিন পাঁচবার নামাজ আদায় করি আমরা। যে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করি তার নাম কিবলা। ‘কিবলাতাইন’ শব্দটি দ্বারা দুটি কিবলা বোঝানো হয়। একই মসজিদে একই নামাজে প্রথমে জেরুজালেম এবং পরে মক্কার দিকে কিবলা পরিবর্তন করার কারণে মদিনা নগরের মসজিদ আল কিবলাতাইন বা দুই কিবলার মসজিদ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ৬২২ খৃস্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর নবী করিম সা. মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেন। হিজরতের দ্বিতীয় বছরে আরবি রজব মাসের মাঝামাঝি সময়ে কিবলা পরিবর্তনের এ ঘটনা ঘটে। হাদিসবিশারদদের মতে, ওই দিন নবীজি সা. এই মসজিদে জোহর বা আসর নামাজ আদায় করছিলেন। দুই রাকাত নামাজ আদায়ের পর হজরত জিব্রাইল আ. জেরুজালেম নগরীর পরিবর্তে মক্কা নগরী অর্থাৎ পবিত্র কাবামুখী হয়ে নামাজ আদায়ের জন্য আল্লাহর নির্দেশ পৌঁছে দেন। নবীজি সা. মহান আল্লাহতায় তালার নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে কিবলা পরিবর্তন করে কাবামুখী হয়ে অবশিষ্ট দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। মসজিদে উপস্থিত সাহাবাগণও একইভাবে নবীজিকে অনুসরণ করে কাবামুখী হয়ে নামাজ আদায় করেন। ফলে এই দিনে একই মসজিদে একই নামাজে দুটি কিবলামুখী হয়ে নামাজ আদায় করা হয়। এ ঘটনার পর থেকেই এ মসজিদটি ‘মসজিদ আল কিবলাতাইন’ বা দুই কিবলার মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে; যার বর্ণনা পবিত্র কুরআনের দ্বিতীয় পারার ১৪৪ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে। ইসলামের ইতিহাসে মসজিদ আল কিবলাতাইনের আবেদন চির ভাস্বর। মদিনায় আগমনকারী দেশ-বিদেশের সব মুসলমান নবীজির স্মৃতিবিজড়িত এই মসজিদটি দর্শন করে এক অনন্য প্রশান্তি অনুভব করে থাকেন।

আরাফার ময়দান : সুবিশাল সবুজ প্রান্তর। দৈর্ঘে দুই মাইল আর প্রস্থে দুই মাইল। যার তিন দিকেই পাহাড়। দক্ষিণ দিকে নব নির্মিত মক্কা শরিফ। এর পাশেই অবস্থিত উম্মুল কোরা বিশ্ববিদ্যালয় নগরী। এই ময়দানেই ৯ জিলহজ্জ হাজিরা অকুফে আরাফাহ করেন, যা হজের অন্যতম ফরজ বা রোকন। মক্কার মোয়াল্লা থেকে আরাফাতের মক্কা সংলগ্ন পশ্চিম সীমান্তের দূরত্ব সাড়ে ২১ কিলোমিটার। ঠিক এ পশ্চিম সীমান্তেই, আরাফাতের সীমানা শুরুর স্থানে দুটো পিলার নির্মাণ করা হয়েছে। আরাফাত সাগরের স্তও থেকে ৭৫০ ফুট ওপরে অবস্থিত। আরাফাতের ময়দানের সকল অংশই হারাম এলাকার বাইরে অবস্থিত। আরাফার ময়দান এক সময় উতপ্ত বালুময় হলেও এখন অবস্থা পাল্টেছে। এখন সেখানে সবুজ বৃক্ষ আর শীতল ফোয়ারার পানি সব সময় পরিবেশকে হালকা করে রাখে। এক সময় এখানে হাজিদের গরমের মধ্যে গাদাগাদি করে থাকতে হতো। এখন পুরো আরাফার ময়দানকে সবুজ ছায়া দিযয়ে ঘিরে রেখেছে। আরাফার ময়দান থেকেই হজের খুতবা দেয়া হয়।

মিনা : আরাফার মতোই আরেকটি বিশাল ময়দানের নাম মিনা। মক্কা নগরীর এক পাশে কাবা শরিফ থেকে সামান্য দূরেই এটি অবস্থিত। পুরো ময়দানটিই সাদা রঙের স্থায়ী তাঁবু দিয়ে সাজানো। দূর থেকে এগুলোকে অসংখ্য গম্বুজ মনে হবে। হাজিদের ৮ জিলহজ জোহরের আগে মিনায় থাকতে হয়। এদিন জোহর থেকে পরের দিন ফজর পর্যন্ত এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া সুন্নত। ৯ জিলহজ তারিখে হাজিদের মিনা থেকে আরাফাহ ময়দানে যেতে হয়। ১০ জিলহজ মুজদালিফায় রাত যাপন করে ১১ জিলহজ সকালে মিনায় ফিরে জামরায় পাথর নিক্ষেপ করতে হয়। জিলহজের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ এই তিনদিন মিনায় অবস্থান করা সুন্নত। মিনার বর্তমান চিত্র খুবই সুন্দর ও পরিপাটি একটি শহর। এটাকে বিশ্বের বৃহত্তর তাবুর শহরও ধরা হয়। ১৮ টি সুবিশাল তাবু নিয়ে গঠিত এই তাবুর শহর। এখানাকার তিন দিন অবস্থানকারী হাজিদের জন্য আরামদায়ক স্থানের জন্যই ধারাবাহিকভাবে কয়েক বছরে বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে তৈরি করা হয় এসব তাবু।

মুজদালিফা : আরাফাত ও মিনার মাঝামাঝি একটি জায়গার নাম মুজদালিফা। ৯ জিলহজ হাজিদেরকে আরাফাহ থেকে সুর্যাস্তের পর মিনার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার পর এখানেই রাত্রি যাপন করে। এখানে হাজিরা মাগরিব ও এশার নামাজ একসাথে আদায় করেন। মুজদালিফার পূর্ব সীমানার পিলারে আল্লাহর কুদরতে হযরত আদম আ. ও হাওয়া আ. দুনিয়াতে আসার পর একসাথে প্রথম মিলিত হয়েছেন বলে রেওয়ায়েত আছে। মুজদালিফাতে অবস্থিত মসজিদটিতে হজের সময় হাজিরা নামাজ আদায় করেন। মুজদালিফায় হাজিদের রাত যাপন করতে হয়। এরপর এখান থেকে কঙ্কর নিয়ে মিনার উদ্দেশে রওনা দেন হন হাজিরা। মুজদালিফায় রাত্রি যাপনের ব্যাপারে রাসূল সা. এরশাদ করেন, মুজদালিফায় রাত্রি যাপনকারীকে আল্লাহ রহমতের চাদরে ঢেকে নেন। সহিহ হাদিস মতে, রাসুলুল্লাহ সা. মুজদালিফার বর্তমানে অবস্থিত মসজিদের স্থানে ফজরের নামাজের পর দুআ ও জিকিরে ব্যস্ত ছিলেন এবং সুর্যোদয়ের আগে আকাশ ফর্সা হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখেন।

মাকামে ইবরাহিম : মক্কার আরেকটি নিদর্শনের নাম মাকামে ইবরাহিম। মাকামে ইবরাহিম একটি পাথম যা কাবা শরিফ নির্মাণের সময় ইসমাইল আ. নিয়ে এসেছিলেন। পাথরটির ওপর দাঁড়িয়ে ইবরাহীম আ. কাবা ঘর নির্মাণ করেন। ইসমাইল আ. পাথর এনে দিতেন, এবং ইবরাহীম আ. তাঁর পবিত্র হাতে তা কাবার দেয়ালে রাখতেন। ওপরে উঠার প্রয়োজন হলে পাথরটি আল্লাহর কুদরতিভাবে ওপরের দিকে ওঠে যেত। পাথরটিতে হজরত ইবরাহিম আ. এর পদচিহৃ রয়েছে। তথ্যে পাওয়া যায়। ইবরাহিম আ. এর পদচিহ্নের একটি ১০ সেন্টিমিটার গভীর, ও অন্যটি ৯ সেন্টিমিটার। লম্বায় প্রতিটি পা ২২ সেন্টিমিটার ও প্রস্থে ১১ সেন্টিমিটার। এক মিলিয়ন রিয়েল ব্যয় করে মাকামের বক্সটি নির্মাণ করা হয়েছে। পিতল ও ১০ মিলি মিটার পুরো গ্লস দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে এটি। ভেতরের জালে সোনা আবরণ দেয়া হয়েছে। হাজরে আসওয়াদ থেকে মাকামে ইবরাহিমের দূরত্ব ১৪.৫ মিটার। তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহিমের পেছনে দু’রাকাত নামাজ আদায় করতে হয়।

হেরা গুহা : ঐতিহাসিক আরেকটি স্থানের নাম গারে হেরা। ইসলামিক নিদর্শনের মধ্যে এটি অনন্য একটি স্থান। এখানে বসেই রাসূল সা. ধ্যান করতেন। ধ্যানমগ্ন রাসূলের ওপর সর্বপ্রথম ওহি নাজিল হয় এখানেই। এখানে হজরম মুহাম্মদ সা. নবুওয়ত লাভ করেন। যে কারণে এ পাহাড় ও গুহাটির মর্যদা অনেক বেশি। হেরা গুহা মক্কার উত্তর দিকে অবস্থিত। মসজিদে হারাম থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার। আর গুহাটি যে পাহাড়ে অবস্থিত তার নাম নূর পাহাড়। এর উচ্চতা ২০০ মিটার এবং এটি একটি খাড়া পাহাড়। মক্কার এটিই সর্বোচ্চ পাহাড়। হেরা গুহাটি পাহাড়ের চূড়া থেকে ৫০ মিটার দূরে। গুহার প্রবেশ পথ উত্তরমুখী এবং এর উচ্চতা মধ্যম আকৃতির একজন মানুষের উচ্চতার সমান। এ গুহাতে এক সাথে ৫ জন লোক বসতে পারেন। এখানকার একটি পাথরে খোদাই করে লেখা আছে সুরা আলাকের আয়াতগুলো।

হাজরে আসওয়দ : পবিত্র কাবার দক্ষিণ কোণে, জমিন থেকে ১.১০ মিটার উচ্চতায় হাজরে আসওয়াদ স্থাপিত। হাজরে আসওয়াদ দৈর্ঘ্যে ২৫ সেন্টিমিটার ও প্রস্থে ১৭ সেন্টিমিটার। শুরুতে হাজরে আসওয়াদ একটুকরো ছিল, কারামিতা সম্প্রদায় ৩১৯ হিজরীতে পাথরটি উঠিয়ে নিজেদের অঞ্চলে নিয়ে যায়। সেসময় পাথরটি ভেঙে ৮ টুকরায় পরিণত হয়। এ টুকরোগুলোর সবচেয়ে বড়টি খেজুরের মতো। টুকরোগুলো বর্তমানে অন্য আরেকটি পাথরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে যার চার পাশে দেয়া হয়েছে রুপার বর্ডার। রুপার বর্ডারবিশিষ্ট পাথরটি চুম্বন নয় বরং তাতে স্থাপিত হাজরে আসওয়াদের টুকরোগুলো চুম্বন বা স্পর্শ করতে পারলেই কেবল হাজরে আসওয়াদ চুম্বন-স্পর্শ করা হয়েছে বলে ধরা হবে। হাজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে নেমে-আসা একটি পাথর (নাসায়ি ৫/২২৬, আলাবানি এ হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন: সহিহু সুনানিন নাসসয়ি ২৭৪৮) যার রং শুরুতে এক হাদিস অনুযায়ী দুধের বা বরফের চেয়েও সাদা ছিল। পরে আদম-সন্তানের পাপ তাকে কালো করে দেয় (তিরমিযি: হজ অধ্যায় ৮৭৭, ইবনু খুজায়মা: ৪/২৮২)। হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করলে গুনাহ মাফ হয় (নাসায়ি ৫/২২১; আলাবানি এ হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন, নং ২৭৩২)। হাজরে আসওয়াদের একটি জিহ্বা ও দুটি ঠোঁট রয়েছে, যে ব্যক্তি তাকে চুম্বন-স্পর্শ করল, তার পক্ষে সে কিয়ামতের দিন সাক্ষী দেবে (আহমদ:১/২৬৬; আলবানি এ হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন। তবে হাজরে আসওয়াদ কেবলই একটি পাথর যা কারও কল্যাণ বা অকল্যাণ কোনোটাই করতে পারে না (সহিহ বুখারি ৩/১৫০২)।

সাফা পাহাড় : কাবা শরীফ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, ১৩০ মিটার দূরে, সাফা পাহাঙ অবস্থিত। সাফা একটি ছোট পাহাঙ যার উপর বর্তমানে গম্বুজ নির্মাণ করা হয়েছে এবং এ পাহাঙের একাংশ এখনও উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। আর বাকি অংশ পাকা করে দেয়া হয়েছে। সমতল থেকে উঁচুতে এই পাকা অংশের ওপরে এলে সাফায় উঠেছেন বলে ধরে নেয়া হবে। সাফা পাহাঙের নির্দিষ্ট জায়গা থেকে এখনও পবিত্র কাবা দেখতে পারা যায়।

মারওয়া পাহাড় : শক্ত সাদা পাথরের ছোট্ট একটি পাহাঙ। পবিত্র কাবা থেকে ৩০০ মিটার দূরে পূর্ব- উত্তর দিকে অবস্থিত। বর্তমানে মারওয়া থেকে কাবা শরীফ দেখা যায় না। মারওয়ার সামান্য অংশ খোলা রাখা হয়েছে। বাকি অংশ পাকা করে ঢেকে দেয়া হয়েছে।

মাসয়া : সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানকে মাসয়া বলা হয়। মাস’আ দীর্ঘে ৩৯৪.৫ মিটার ও প্রস্থে ২০ মিটার। মাসআ’র গ্রাউন্ড ফ্লোর ও প্রথম তলা সুন্দরভাবে সাজানো। গ্রাউন্ড ফ্লোরে ভিঙ হলে প্রথম তলায় গিয়েও সাঈ করতে পারেন। প্রয়োজন হলে ছাদে গিয়েও সাঈ করা যাবে তবে খেয়াল রাখতে হবে আপনার সাঈ যেন মাসআ’র মধ্যেই হয়। মাসআ থেকে বাইরে দূরে কোথাও সাঈ করলে সাঈ হয় না।

রুকনে ইয়ামানি : কাবা শরীফের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ। তাওয়াফের সময় এ কোণকে সুযোগ পেলে স্পর্শ করতে হয়। চুম্বন করা নিষেধ। হাদিসে এসেছে, ইবনে ওমর (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে দুই রুকনে ইয়ামানি ব্যতীত অন্য কোনো জায়গায় স্পর্শ করতে দেখিনি। (সহিহ বুখারি ৩/১৫১৩)

মুলতাজাম : হাজরে আসওয়াদ থেকে কাবা শরীফের দরজা পর্যন্ত জায়গাটুকুকে মুলতাজাম বলে (আল মুসান্নাফ লি আব্দির রাজ্জাক: ৫/৭৩)। মুলতাজাম শব্দের আক্ষরিক অর্থ এঁটে থাকার জায়গা। সাহাবায়ে কেরাম মক্কায় এসে মুলতাযামে যেতেন ও দু’হাতের তালু, দু’হাত, ও চেহারা ও বক্ষ রেখে দোয়া করতেন। বিদায় তাওয়াফের পূর্বে বা পরে অথবা অন্য যে কোনো সময় মুলতাযামে গিয়ে দোয়া করা যায়। ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) বলেন, যদি মুলতাযামে আসার ইচ্ছা করে মুলতাজাম হল হাজরে আসওয়াদ ও দরজার মধ্যবর্তী স্থানÑ অতঃপর সেখানে তার বক্ষ, চেহারা, দুই বাহু ও দুই হাত রাখে ও দোয়া করে, আল্লাহর কাছে তার প্রয়োজনগুলো সওয়াল করে তবে এরূপ করার অনুমতি আছে। বিদাযড় তাওয়াফের পূর্বেও এরূপ করতে পারবে। মুলতাজাম ধরার ক্ষেত্রে বিদাযড় অবস্থা ও অন্যান্য অবস্থার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আর সাহাবগণ যখন মক্কায় প্রবেশ করতেন তখন এরূপ করতেন (শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার মজমূউল ফতুওয়া: ২৬/১৪২)। তবে বর্তমান যুগে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিঙে মুলতাযামে ফিরে যাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই সুযোগ পেলে যাবেন অন্যথায় যাওয়ার দরকার নেই। কেননা মুলতাযামে যাওয়া তাওয়াফের অংশ নয়।

মাতাফ : কাবা শরীফের চার পাশে উন্মুক্ত জায়গাকে মাতাফ বলে। মাতাফ শব্দের অর্থ, তাওয়াফ করার জায়গা। মাতাফ সর্বপ্রথম পাকা করেন আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, কাবার চার পাশে প্রায় ৫ মিটারের মত। কালক্রমে মাতাফ সম্প্রসারিত করা হয়। বর্তমানে শীতল মারবেল পাথর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে মাতাফ যা প্রচণ্ড রোদের তাপেও শীতলতা হারায় না, ফলে হজকারীগণ আরামের সাথে পা রেখে তাওয়াফ সম্পন্ন করতে পারেন।

হাতিম : কাবাঘরের উত্তর পাশে একটু উঁচু স্থানে দেয়াল দিয়ে ঘেরা অংশই হাতিম। শবে মেরাজের রাতে এই স্থানে হুজুর সা.’কে জিবরাইল আ. বক্ষ বিদীর্ণ করে জমজমের পানি দিয়ে হৃৎপি- ধুয়ে দিয়েছিলেন।

সাওর পাহাড় : মসজিদুল হারাম থেকে ছয় কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। হুজুর সা. ও আবুবকর রা. মক্কা থেকে মদিনায় প্রথম হিজরতের সময় এই পাহাঙের চূঙার একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সাওর পাহাঙের উচ্চতা চার হাজার ফুট।

আবু কুবাইস পাহাড় : মক্কা মুয়াজ্জামার পূর্ব প্রান্তে এই পাহাঙ অবস্থিত। এই পাহাঙের কাছে একটি উপত্যকায় হুজুর সা. তিন বছর সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কট অবস্থায় চরম কষ্টের মধ্যে ছিলেন। নূহ আ. মহাপ্লাবনের সময় হাজরে আসওয়াদকে এই পাহাঙে রেখেছিলেন। এই পাহাঙের কাছে দাঁডড়য়ে নবী করিম সা. আঙুলের ইশারায় চাঁদ দ্বিখ-িত করেন।

মসজিদুল হারাম : কাবা শরীফ, ও তার চার পাশের মাতাফ, মাতাফের ওপারে বিল্ডিং, বিল্ডিঙের ওপারে মারবেল পাথর বিছানো উন্মুক্ত চত্বর এ সবগুলো মিলে বর্তমান মসজিদুল হারাম গঠিত। কারও কারও মতে পুরা হারাম অঞ্চল মসজিদুল হারাম হিসেবে বিবেচিত। পবিত্র কুরআনের এক আয়াতে এসেছে, তোমরা অবশ্যই মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে (সূরা আলফাত্হ: ২৭) অর্থাৎ হারাম অঞ্চলে প্রবেশ করবে। সূরা ইসরায় মসজিদুল হারামের কথা উল্লেখ হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, পবিত্র সেই সত্তা যিনি তাঁর বান্দাকে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় রাতের বেলায় নিয়ে গেলেন, যার চার পাশ আমি করেছি বরকতময় (সূরা আল ইসরা:১) । ইতিহাসবিদদের মতানুসারে রাসূলুল্লাহ (সা.) কে উম্মে হানীর ঘরের এখান থেকে ইসরা ও মেরাজের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর তৎকালে কাবা শরীফের চারপাশে সামান্য এলাকা জুঙে ছিল মসজিদুল হারাম, উম্মে হানীর ঘর মসজিদুল হারাম থেকে ছিল দূরে। তা সত্ত্বেও ওই জায়গাকে মসজিদুল হারাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

মসজিদে মিকাত : মদিনা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে মসজিদে নববী থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এ মসজিদটি অবস্থিত। ঐতিহাসিক আকিক উপত্যকার পশ্চিম পাশেই মসজিদটির অবস্থান। রাসুলুল্লাহ সা. হজ বা উমরাহ পালনের উদ্দেশে মক্কা যাওয়ার সময় এখানকার একটি গাছের নিচে নামতেন এবং সেখানে সালাত আদায় করে উমরাহ অথবা হজের ইহরাম বাঁধতেন। এ কারণেই মসজিদটিকে শাজারাহ্ বলা হয়। এটি মদিনাবাসীর মিকাত বলে এ মসজিদটি মসজিদে মিকাত নামে পরিচিত।

মসজিদে জুমুয়া : রাসুলুল্লাহ সা. হিজরতের সময় কুবার অদূরে রানুনা উপত্যকায় একশ’ জন সাহাবাকে নিয়ে মসজিদে জুমুআর স্থানে প্রথম জুমুয়ার নামাজ আদায় করেন। পরবর্তিতে এটি মসজিদে জুমুআ নামে পরিচিত হয়ে যায়।

মসজিদে গামামাহ : এ মসজিদকে মুসাল্লাহও বলা হয়। রাসুলুল্লাহ সা. প্রথম ঈদের নামাজ ও শেষ জীবনের ঈদের নামাজগুলো মসজিদে গামামাহর স্থানে আদায় করেন। এ স্থানে নবীজি সা. বৃষ্টির জন্য নামাজ পঙেছেন বলে একে মসজিদে গামামাহ বলা হয়। এটি মসজিদে নববীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত।

মসজিদে আবু বকর রা. : এটি মসজিদে গামামাহর উত্তরে অবস্থিত। হজরত আবু বকর রা. খলিফা থাকাকালে এ মসজিদে ঈদের নামাজ পঙান। তাই এটি মসজিদে আবু বকর রা. হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

মসজিদে কুবা : হজরত মুহাম্মদ সা. মদিনায় আগমন করে প্রথম শহরের প্রবেশদ্বারে কুবায় নামাজ পঙেন। পরে এখানে একটি মসজিদ গঙে ওঠে। মসজিদটি মসজিদে কুবা হিসাবেই পরিচিতি লাভ করে। হজে সময় পেলে দেখে আসতে পারেন মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়, কুরআন ছাপা প্রকল্প। এখানে প্রতি মিনিটে ৫০০ কুরআন ছাপা হয়। দেখতে পারেন ওহুদ বদর প্রান্তর। যে স্থান গুলোতে নবীজি যুদ্ধ করে অর্জন করেছেন ইসলামের বিজয়।

নবীজী সা.-এর বাড়ি : মসজিদুল হারাম থেকে প্রায় ৪৪০ গজ পূর্বে হুজুর সা.-এর পিতার বাডড়। এখানে হুজুর সা.-এর জন্ম হয়। এই বাডড়টি এখন পাঠাগার। হুজুর সা.-এর বাসগৃহ ও মসজিদুল হারামের মাঝে ছিল আবু জাহলের বাডড়। বর্তমানে এই বাডড়টিতে গোসলখানা, প্রগ্রাবখানা ও পায়খানা করা হয়েছে।

জান্নাতুল মুয়াল্লা : মাসজিদুল হারাম থেকে উত্তর দিকে আনুমানিক দুই কিলোমিটার দূরে এই গোরস্থান। এখানে খাদিজা রা., নবী করিম সা., মাতা আমিনা, দাদা আব্দুল মোত্তালিব, চাচা আবু তালেব, পুত্র কাসেম রা.সহ অনেক সাহাবির রওজা পাক অবস্থিত।

রওজায়ে জান্নাত : হুজরায়ে মোবারক ও মিম্বার শরিফের মাঝখানের জায়গাটি ‘রওজায়ে জান্নাত’ বা ‘রিয়াজুল জান্নাহ’ বা ‘বেহেশতের বাগান’ নামে পরিচিত। এ স্থানটির বিশেষ ফজিলত রয়েছে। এখানে নামাজ পড়ারও বিশেষ ফজিলত আছে। মসজিদে নববীর ভেতরে কয়েকটি স্তম্ভ রয়েছে সেগুলোকে রহমতের স্তম্ভ বা খুটি বলে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তৈরি মসজিদে খেজুর গাছের খুঁটিগুলোর স্থানে উসমানী সুলতান আব্দুল মাজিদ পাকা স্তম্ভ নির্মাণ করেন। এগুলোর গায়ে মর্মর পাথর বসানো এবং স্বর্নের কারুকাজ করা। প্রথম কাতারে ৪টি স্তম্ভের লাল পাথরের এবং পাথর্ক্য করার সুবিধার জন্য সেগুলোর গায়ে নাম অংকিত রয়েছে।

উস্তুওয়ানা হান্নানা (সুবাস স্তম্ভ) : মিম্বারে নববির ডান পাশে খেজুরগাছের গুঁড়ির স্থানে নির্মিত স্তম্ভটি। নবী করিম (সা.) মিম্বার স্থানান্তরের সময় এ গুঁড়িটি উঁচু স্বরে কেঁদেছিলেন।

উস্তুওয়ানা সারির : এখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইতিকাফ করতেন এবং রাতে আরামের জন্য তাঁর বিছানা এখানে স্থাপন করা হতো। এ স্তম্ভটি হুজরা শরিফের পশ্চিম পাশে জালি মোবারকের সঙ্গে রয়েছে।

উস্তুওয়ানা উফুদ : বাইরে থেকে আগত প্রতিনিধিদল এখানে বসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করতেন এবং এখানে বসেই কথা বলতেন। এ স্তম্ভটিও জালি মোবারকের সঙ্গে রয়েছে।

উস্তুওয়ানা আয়েশা (আয়েশা স্তম্ভ) : নবী করিম (সা.) বলেছেন, আমার মসজিদে এমন একটি জায়গা রয়েছে, লোকজন যদি সেখানে নামাজ পড়ার ফজিলত জানত, তাহলে সেখানে স্থান পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করত। স্থানটি চিহ্নিত করার জন্য সাহাবায়ে কিরাম চেষ্টা করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর হজরত আয়েশা (রা.) তাঁর ভাগ্নে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) -কে সে জায়গাটি চিনিয়ে দেন। এটিই সেই স্তম্ভ। এই স্তম্ভটি উস্তুওয়ানা উফুদের পশ্চিম পাশে রওজায়ে জান্নাতের ভেতর।

উস্তুওয়ানা আবু লুবাবা (তওবা স্তম্ভ): হজরত আবু লুবাবা (রা.) থেকে একটি ভুল সংঘটিত হওয়ার পর তিনি নিজেকে এই স্তম্ভের সঙ্গে বেঁধে বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত হুজুরে পাক (সা.) নিজে না খুলে দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এর সঙ্গে বাঁধা থাকব।’ নবী করিম (সা.) বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে আল্লাহ আদেশ না করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত খুলব না।’ এভাবে দীর্ঘ ৫০ দিন পর হজরত আবু লুবাবা (রা.)-এর তওবা কবুল হলো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে তাঁর বাঁধন খুলে দিলেন। এটি উস্তুওয়ানা উফুদের পশ্চিম পাশে রওজায়ে জান্নাতের ভেতর অবস্থিত।

উস্তুওয়ানা জিবরাইল : ফেরেশতা হজরত জিবরাইল (আ.) যখনই হজরত দেহইয়া কাল্বী (রা.)-এর আকৃতি ধারণ করে ওহি নিয়ে আসতেন, তখন অধিকাংশ সময় তাঁকে এখানেই উপবিষ্ট দেখা যেত।

মিহরাবে নববি : মাকরুহ ওয়াক্ত না হলে কাউকে কষ্ট না দিয়ে এখানে নফল নামাজ পড়–ন। মিহরাবের ডানে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দাঁড়ানোর জায়গা।

ওহুদ প্রান্তর : ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় যুদ্ধ সংঘঠিত হয় এই প্রান্তরে। দুই মাথাওয়ালা একটি পাহাড়, দুই মাথার মাঝখানে একটু নিচু স্থানের মতো রয়েছে -এটাই ওহুদের পাহাড়। তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।