প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধের ঘটনা যদি না হতো তাহলে আমাদের জিডিপির পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য সাত শতাংশে উন্নীত করতে পারতাম।’
তিনি বলেন, ‘যে বাজেট আমরা দিয়েছি, হয়তো পাঁচ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে। যা প্রতি বছরই দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও আমরা বাস্তবায়ন করব। সকলে সহযোগিতা করুন, আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব।’
দশম সংসদের দ্বিতীয় বাজেট অধিবেশনে সোমবার ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ সব কথা বলেন।
নেপাল, ভুটান, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পরিবহন চুক্তির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই পরিবহন চুক্তি আমাদের জন্য অফুরন্ত সুযোগ বয়ে আনবে। আমরা বিশ্বাস করি, বর্তমান সময়ে একটা দেশ এককভাবে উন্নতি করতে পারে না। সামষ্টিক চেষ্টা একান্তভাবে প্রয়োজন। যে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার দীর্ঘদিন আমার একটা প্রচেষ্টা ছিল।’
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘সুন্দরবনকে রক্ষা করা মানে আমার দেশকে রক্ষা করা। সেখানে আমার দরদ থাকবে না আর অন্য কারো বেশি দরদ থাকবে— এটা আমি বিশ্বাস করি না। কথায় বলে, ‘মায়ের পোড়ে না, পোড়ে মাসির’। বাংলাদেশের উন্নতিটা অনেকের ভাল লাগে না, এটা হল বাস্তবতা।’’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে মাত্র সাড়ে তিন বছরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন দুর্ভাগ্যবশত পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট এ দেশের জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হল। জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হল। এরপর থেকে এ দেশে সংবিধান সম্পূর্ণভাবে অবহেলিত। সংবিধান লঙ্গন করে হত্যা, ক্যুর রাজনীতি শুরু হয়। জনগণের কোনো অধিকার ছিল না। না ভোটের অধিকার, না গণতান্ত্রিক অধিকার। কথা বলার অধিকারও ছিল না। মিলিটারি রুল দিয়েই দেশ চলেছে। ২১টি বছর বাংলাদেশের মানুষ কষ্ট করেছে।’
তিনি বলেন, ‘২১ বছর পর আওয়ামী লীগ যখন ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করল, তখনই এ দেশের মানুষ প্রথম উপলব্দি করল সরকার জনগণের সেবা ও কল্যাণে কাজ করে। বাংলাদেশের জনগণের জন্য ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ছিল স্বর্ণযুগ। তারপর আবার অন্ধকারের অমানিশায় ঢেকে যায় বাংলাদেশ। সাতটি বছর এ দেশের মানুষ কষ্ট করেছে। ২০০৮-এর নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করি। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করি। ১০ বছর মেয়াদী প্রেক্ষিত পরিকল্পনা গ্রহণ করি। সেই ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করছি বলেই আজ বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।’
তিনি এ সময় দারিদ্র্যের হার ও অতিদারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা, গড় আয়ু বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপসহ বিভিন্ন অর্জন ও পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী মন্দার কারণে অনেক দেশ জিডিপি ধরে রাখতে পারেনি। আমাদের দেশে কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের জ্বালাও-পোড়াও, মানুষ হত্যা ও শত বাধা অতিক্রম করেও আমরা আমাদের জিডিপি ৬.৫১ শতাংশে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। হয়তো এই বাধাগুলো যদি না আসতো, তিন মাস একটানা জ্বালাও-পোড়াও এবং হরতাল-অবরোধের ঘটনা যদি না থাকতো, তাহলে আমরা আমাদের জিডিপির সাত শতাংশে উন্নীত করার যে লক্ষ্য ছিল সেটা অর্জন করতে পারতাম। এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
তিনি বলেন, ‘আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দিক থেকে বাংলাদেশ আজ রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। সবাই প্রশংসা করছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া নতুন কিছু নয়, আগেও ছিল। ক্ষমতায় আসার পর মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের অবৈধ শ্রমিকদের বৈধ করা হয়েছে। অবৈধভাবে বিদেশে না যাওয়ার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করছি। তারপরও দুঃখজনক ঘটনা যে, কিছু লোক অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে।’
ক্রিকেট জয়ের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পাকিস্তানকে যেমন হোয়াইটওয়াশ করেছি, তেমনি ভারতের বিরুদ্ধেও সিরিজ জয় করেছি। আমি অসুস্থ থাকায় মাঠে যেতে পারেনি। ইচ্ছা ছিল ট্রফিটি নিজের হাতে তুলে দেওয়ার।’
ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ইদানিং একটা রাজনৈতিকগোষ্ঠী মানুষ পুড়িয়ে যেন আত্মতুষ্টি লাভ করেছে। তারা মানুষ পুড়িয়ে আনন্দ পায়। আমরা সবধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিয়েছি।’
জঙ্গিবাদের ব্যাপারে সরকারের জিরো টলারেন্সের রয়েছে বলেও প্রধানমন্ত্রী ফের উল্লেখ করেন।
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে বিরোধিতাকারীদের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার প্রশ্ন, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হচ্ছে দিনাজপুর। সেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। প্রকৃতির সেখানে কি ক্ষতি হয়েছে? কেউ দেখাতে পারবেন যে সেখানে ক্ষতি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘শেয়ারবাজার যাতে আরও গতিশীল হয় সে জন্য ক্ষুদ্র বিনোয়োগকারীদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারের পদক্ষেপের কারণে শেয়ারবাজার এখন স্থিতিশীল। মাঝেমধ্যে কিছু খেলার চেষ্টা করা হয়। তখন আমরা সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নেই।’
মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা আমাদের একটা সাফল্য। রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইতোমধ্যে আপনারা জানেন, নেপাল, ভূটান, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পরিবহন চুক্তি করেছি। এর ফলে যেন আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আর ভালভাবে বৃদ্ধি পায় সেই ব্যবস্থা নিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আমি নেপাল ও ভারতের সঙ্গে একমত হয়ে ভারতকে বলেছি, আমাদের ট্রানজিট প্রয়োজন। নেপাল, ভুটান, ভারত ও বাংলাদেশ মিলে যে পরিবহন চুক্তি করেছি তা আমাদের জন্য অফুরন্ত সুযোগ বয়ে আনবে।’
পররাষ্ট্রনীতিতে সরকারের সাফল্যের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সকলের সঙ্গে একটা সুন্দর সম্পর্ক রেখে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’
তিনি ভারতে সঙ্গে সমুদ্রসীমা জয় ও স্থলসীমানা চুক্তি বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সফলতায় আমরা এটা করতে পেরেছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আধুনিক প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়তে নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নে আমরা ক্ষমতায় এসে যত কাজ করেছি, সশস্ত্র বাহিনীর যারা ক্ষমতায় ছিল তারাও এত কাজ করেনি।’
বাজেট প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে বাজেট আমরা দিয়েছি হয়তো পাঁচ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে। যা প্রতি বছরই দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও আমরা বাস্তবায়ন করব। সকলে সহযোগিতা করুন, আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব।’
প্রধানমন্ত্রী এ সময় প্রস্তাবিত বাজেটে ধার্য করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের ওপর কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে সাত শতাংশ এবং গার্মেন্টস খাতে রফতানি শুল্কহার কামানোর আহ্বান জানান।