বাংলাদেশের তরুণদের অনেকে মনে করেন, দেশে দুর্নীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। কিন্তু সেভাবে প্রতিকার নেই। দুর্নীতি ছাড়াও আরও কয়েকটি বড় সমস্যা হল- সরকারের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কম। নেই রাজনৈতিক স্বাধীনতা। সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ঘাটতিও যথেষ্ট। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বা সংক্ষেপে ডব্লিউইএফ) পরিচালিত এক জরিপ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ৯ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।

এদিকে দেশ সম্পর্কে তরুণদের এমন মতামতের সঙ্গে দ্বিমত বা চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ নেই বলে অভিমত দিয়েছেন বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক। এ বিষয়ে শুক্রবার যুগান্তরকে দেয়া পৃথক প্রতিক্রিয়ায় তারা সামগ্রিকভাবে তরুণদের মতের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, বাস্তব এ সংকটগুলো সবার জানা আছে। আর সমাধান করার জন্য কোনো ম্যাজিক বুলেটের প্রয়োজন নেই। জানা বিষয়, শুধু প্রতিপালন করলেই হয়।

প্রসঙ্গত, ডব্লিউইএফ’র জরিপটি ‘গ্লোবাল শেপার্স সার্ভে-২০১৬’ নামে পরিচালিত হয়। এতে অংশ নেন বিশ্বের ১৮৭টি দেশের ২৬ হাজার ৬১৫ জন তরুণ। তাদের মধ্যে বাংলাদেশের ছিলেন ৬৭২ জন। জরিপে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে তরুণদের হতাশার চিত্র উঠে এসেছে। প্রায় ৭৬ শতাংশ তরুণই বলেছেন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি তাদের সবচেয়ে বেশি হতাশ করে। আরও হতাশাজনক হচ্ছে, রাজনৈতিক নেতাদের স্বচ্ছতার অভাব। এ ছাড়া ৩৯ শতাংশ তরুণ মনে করেন, নেতাদের মধ্যে অসততা ও আন্তরিকতার ঘাটতি আছে।

তরুণদের এসব মতামত নিয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবেদনে প্রকাশিত তরুণদের মতের সঙ্গে আমি মোটামুটি একমত। দুর্নীতি যে আমাদের বিরাট সমস্যা এটি টিআইবি বিভিন্ন সময় বলেছে। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের সুশাসন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিু। কাজেই এটাতো আছেই। তাছাড়া দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা না থাকলেও স্থানীয় পর্যায় ছাত্রনেতাসহ স্থানীয় রাজনীতিবিদদের বিভিন্ন ঘটনা আছে। কিছু মানুষ গুম হয়। সম্প্রতি বিমানবন্দরে যে ঘটনা ঘটল, সেখানে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা থাকার কথা। কিন্তু যে ধরা পড়েছে তার পরিচয়ও এখনও মেলেনি। সে ওখানে কেন এবং কীভাবে গেল সেটিও জানা যায়নি। সব মিলিয়ে ওয়ার্ল£ ইকোনমিক ফোরামের জরিপে তরুণদের মূল্যায়ন ঠিকই আছে।’

তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে রাজনৈতিকভাবে। এখন দুর্নীতি দমন কমিশন কিছুটা অ্যাকটিভ হয়েছে। এটা চালু রাখতে পারলে ভালো হবে। দেশের জনগণের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, কর্মসংস্থানের জন্য বিনিয়োগ দরকার। বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২১ থেকে ২২ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে দীর্ঘদিন ধরে। কর্মসংস্থান বাড়াতে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পরিবহন অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটানো জরুরি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অনেকেই প্রতিবেদনটির সমালোচনা করতে পারেন। বলতে পারেন এটি পুরো দেশের তরুণদের মত নয়। কিন্তু জরিপে যারা অংশ নিয়েছেন তারা বাস্তব অভিজ্ঞতা বা চোখের সামনে যা দেখছেন তাই মত দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তাদের মত চ্যালেঞ্জ বা দ্বিমত করার উপায় নেই। তিনি বলেন, এর সমাধানে তরুণরাই বলেছে ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। যারা দুর্নীতির জন্য দায়ী তাদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যে কথাগুলো আমরা সব সময় বলছি। তিনি বলেন, দুর্নীতি বন্ধ করতে ম্যাজিক বুলেটের দরকার নেই। সবই জানা বিষয়, কিন্তু মানা হয় না।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে. মুজেরি বলেন, সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে। যে তরুণরা এ জরিপে মতামত দিয়েছেন আগামী দিনে তারা সমাজ ও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাদের মতামতের সঙ্গে আমি একমত। তবে একটি বিষয় বারবার সামনে চলে আসছে। তা হল- যদি দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে চাই তাহলে কিছু বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন- স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকলে অন্য ক্ষেত্রে যতই এগিয়ে যেতে চাই না কেন লাভ হবে না। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অর্জিত না হলে সব অর্জনই ব্যর্থ হবে। তাই তরুণদের মতামতের সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন স্তরের জনগণের মতামত একই হবে। তবে এটাকে সামগ্রিক মতামত বলা যাবে না।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে যুব সমাজের চিন্তা, চেতনা, আকাক্সক্ষাকে প্রতিফলন করে এমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই। এ ধরনের জরিপের মাধ্যমে যখন তরুণদের অভিমত জানতে পারি তখন হতচকিত লাগে। এতে প্রমাণ হয় যুব সমাজ মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করে। জরিপে উত্তরদাতারা যেসব বিষয় চিহ্নিত করেছেন তার সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ অত্যন্ত সামান্য। এমনকি যেসব প্রাধিকারকে উল্লেখ করেছে সেগুলো প্রণিধানযোগ্য, সবই আমলে নিতে হবে। সমাজে জবাবদিহিতার অভাব, দুর্নীতির অবাধ বিচরণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্খলন এবং এসবের ফলে একটি অসম সমাজ গড়ে উঠছে। যেখানে অনেক ক্ষেত্রে নাগরিক অধিকার বিঘ্নিত হয়ে থাকে। এই বার্তা রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক নেতারা গুরুত্বের সঙ্গে নেবেন বলে তিনি আশা করেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, তরুণদের মতামতে দ্বিমত করার সুযোগ কি আছে? স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা যেমন- নির্বাচন কমিশন, আদালত ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এসবই ভেঙে পড়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনী দায়বদ্ধতাও নেই। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ সরকারের ওপর অখুশি হলে ভোট দেয়ার মাধ্যমে বিদায় দিতে পারত। এখন সে অবস্থা নেই। কারণ নির্বাচনী দায়বদ্ধতার কাঠামো ভেঙে পড়েছে। সঙ্গত কারণে এসবের প্রতিকার করা দরকার। তা না হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন হচ্ছে, জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে, তেমন হবে। এখনই এসব বিষয়ের প্রতিকার করা উচিত, না হলে পরিণতি খারাপ হবে।

এদিকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদের মতামত একটু ভিন্ন। তিনি মনে করেন, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জরিপে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ঘাটতির কথা বলা হলেও বাংলাদেশে কোনোটিরই অভাব নেই। কিন্তু এটি এখন সাইকোলজিক্যাল ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। শুধু তরুণ নয়, সময় এসেছে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের মনোভাব পরিবর্তনের। তিনি আরও বলেন, দুর্নীতি কমিয়ে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতেই সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়েছে। দুর্নীতি ঠেকাতে ই-টেন্ডারিং চালু করেছে। অন্যসব সংস্থা ডিজিটালাইজ করছে। এক্ষেত্রে সরকার অনেকাংশে সফল। তবে পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত হয়েছে সেটা বলা যাবে না। এটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, আগে আরজেএসসি (রেজিস্টার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ) থেকে কোম্পানির নিবন্ধন পেতে ঘুষ দিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো। এখন অনলাইনে আবেদন করে মাত্র ৩ মিনিটেই ৩০০ টাকা খরচ করে নিবন্ধন পাওয়া যাচ্ছে। তার মতে, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জরিপ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আটকে রাখার অপপ্রয়াস হতে পারে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এত অভিযোগের পরও প্রবৃদ্ধির হার প্রশংসনীয়। জরিপে প্রাতিষ্ঠানিক যেসব বাধা তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো সব উন্নয়নশীল দেশে সব সময় থাকে। তিনি মনে করেন, সুশাসনের ব্যাপারে জনগণের অভিযোগ থাকবেই। এত সীমাবদ্ধতার পরও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে যেসব ইস্যু জরিপে তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। পলিসি রিফর্ম ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে অতিক্রম করা সম্ভব।

জরিপের কিছু প্রশ্নোত্তর : জরিপে রাজনীতি বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তরুণরা বলেছেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সাধারণ জনগণের মনোভাব বুঝতে পারার ব্যর্থতা রয়েছে। এর বাইরে সময়মতো ব্যবস্থা না নেয়া, অনড় মনোভাব, প্রভাবশালীদের বিশেষ সুবিধা দেয়া, সেকেলে চিন্তা-ভাবনাকেও বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম সমস্যা মনে করেন তারা। সরকার কী কী উপায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দেখাতে পারে? এ রকম প্রশ্নের জবাবে ৬২ শতাংশ বাংলাদেশী তরুণ বলেন, সরকারের মধ্যে যাদের সুশাসনের ঘাটতি দেখা দেবে, তাদের দৃশ্যমান শাস্তি দিতে হবে। ৪৭ শতাংশের মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। ৩৮ শতাংশের মতে, সরকারের সমালোচনা করতে দিতে হবে, রাখতে হবে বিক্ষোভ দেখানোর সুযোগ। অপর এক প্রশ্নের জবাবে ৬৫ শতাংশ তরুণ তাদের মতামত তুলে ধরে বলেন, দুর্নীতি আছে কিন্তু সেভাবে প্রতিকার নেই। স্বচ্ছতার অভাব তো আছেই। এ ছাড়া ৪৮ শতাংশের মতে, এখানে ভালো মানের শিক্ষার সুযোগ সবাই সমানভাবে পাচ্ছে না, যা শিক্ষা খাতে বৈষম্য বাড়াচ্ছে। আরও আছে রাজনৈতিক মতপার্থক্য। তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান তৈরিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো কী? এর জবাবে ৫০ শতাংশ তরুণ মনে করেন, নতুন উদ্যোগ তাদের কর্মসংস্থানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ৪৫ শতাংশ মনে করেন ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগও গুরুত্বপূর্ণ। ৪২ শতাংশ তরুণ মুক্ত গণমাধ্যম অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে তাদের কর্মসংস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মত দিয়েছেন।