পাঠকদের নিশ্চয় মনে হচ্ছে জীন থেরাপি তো খুব সোজাসাপ্টা একটা ব্যাপার কিন্তু বাস্তবে এর থেকে কঠিন এবং জটিল ব্যাপার আর আছে কিনা সন্দেহ, আসল ব্যাপারটা এখানে খুব সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। গবেষকরা এখনো নিশ্চিত নয় যে জীন থেরাপি কতটা নিরাপদ কারণ এটা জীন নিয়ে কাজ করে আর জীনের সামান্য পরিবর্তন অনেক বড় কিছু করে ফেলতে পারে আবার একটা জীন অনেক ক্ষেত্রে একাধিক জীন বা বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে (Polymorphism) তাই একটা নির্দিষ্ট জীন পরিবর্তন করতে গিয়ে অন্য অনেক বড় ত্রুটির সৃষ্টি হতে পারে।
জীন থেরাপিতে ভালো জীনটিকে একটা সুনির্দিষ্ট জায়গায় বসাতে হয়, ঠিকঠাক জায়গায় না বসাতে পারলে বড় ধরনের কোন ক্ষতি হতে পারে। জীন থেরাপিতে বিভিন্ন রকমের ভাইরাস কে বাহক হিসাবে ব্যবহার করা হয়, এই বাহক ভাইরাস খারাপ কোষকে আক্রমণ না করে ভালো কোষকে আক্রমণ করতে পারে। অনেক সময় যদি ভাইরাস বাহক নির্দিষ্ট কোষকে আক্রমণ না করে রোগীর জননকোষ আক্রমণ করে তাহলে তার পরবর্তী বংশধরও ক্ষতির কবলে পড়তে পারে। তাছাড়া জীনের সামান্যতম পরিবর্তন ক্যান্সার পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া, আমাদের শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (Immune System) আছে, শরীরে অপরিচিত কিছু প্রবেশ করলেই এটা তাদের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করে দেয়, তাই জীন থেরাপির ক্ষেত্রে যখন বাহক শরীরে প্রবেশ করা হয় তখন হিতে বিপরীত হতে পারে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা রাখতে হলে জীন থেরাপিকে এসব জটিলতা দূর করতে হবে। বিজ্ঞানীদের আরও কার্যকর বাহক খুঁজে বের করতে হবে যা আরও বেশি সংখ্যক কোষের উপরে কাজ করতে পারে, নতুন পন্থা উদ্ভাবন করতে হবে যেন আরও বেশি সংখ্যক বাহক উৎপাদন করা যায় এবং আরও কার্যকর প্রমোটার খুঁজে বের করতে হবে যেন যথেষ্ট পরিমাণে প্রোটিন উৎপাদিত হয়। তবে জীন থেরাপি যেহেতু অনেক নতুন একটা পদ্ধতি তাই এর সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবের কারণে অনেক সাধারণ বিষয় হয়ত অনেক জটিল মনে হচ্ছে কিন্তু ভবিষ্যতে হয়ত আজকের অনেক সমস্যাই আর সমস্যা থাকবেনা।
–
জীন থেরাপি এখনো আতুর ঘর থেকে বাইরে বের হয়নি কিন্তু এর মধ্যেই বিজ্ঞানীরা তার প্রেমে পড়ে গেছে এবং তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। জীন থেরাপি এমন একটা পদ্ধতি যেটা দিয়ে অসম্ভবকে জয় করা সম্ভব। পৃথিবীতে অন্ধ, বধির, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, স্মৃতিভ্রষ্টটা শব্দগুলোর অস্তিত্ব আর যেন থাকছে না। অনেক দুরারোগ্য ব্যাধি যেমন হাঁপানি, ডায়াবেটিস, হিমোফিলিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে জীন থেরাপি বিজ্ঞানীদের চোখে আশার আলো জ্বেলে দিয়েছে, স্বপ্নের সোনার হরিণ যেন ধরা দিল বিজ্ঞানীদের হাতে।
মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও মানবদেহে অনেক ত্রুটি বিদ্যমান যা অনেক নিম্নমানের প্রাণীতে অনুপস্থিত, যেমন, মানুষের চোখ খুব দুর্বল সে তুলনায় অক্টোপাস বা আমাদের চিরচেনা কুকুর, বিড়ালের চোখ অনেক উন্নত, বয়স বাড়ার সাথে মাংসপেশি ও হাড়ের ক্ষয় শুরু হয় এটাও একটা বিরাট সমস্যা। দেখা গেছে আমাদের দেহ ত্রিশ বছর পার না করতেই হাড়ের ক্ষয় (Bone Decay) শুরু হয় ফলে হাড়ের ভঙ্গুরতা বৃদ্ধি পায় এবং একটা সময় অস্টিওপরেসিস (Osteoporosis) মত রোগের উদ্ভব হয়, মানুষের উপরের অংশের ভর নিচের অংশ পুরোপুরি নিতে পারেনা যে কারণে বৃদ্ধ বয়সে পশ্চাৎ দিকে ব্যথা (Backpain), বাত সহ নানা রকম অসুখে ভুগি আমরা, মানব জিনোমে অনেক অপ্রয়োজনীয় জীন (Junk DNA) আছে যা অনেক ক্ষতিকর অভিব্যক্তি (Mutation) ঘটাতে পারে – জীন থেরাপির মাধ্যমে এসব ত্রুটি দূর করা যেতে পারে।
বিজ্ঞান আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে কিন্তু মৃত্যুকে এড়াতে পেরেছে কি! অবাক হলেও সত্যি যে বিজ্ঞানীরা এখন মৃত্যুকে উপেক্ষা করতে চেষ্টা করছে, কারণ স্বাভাবিক মৃত্যুকে এক ধরনের জেনেটিক ডিজিজ বলা যেতে পারে এবং আশার কথা হল প্রাণিজগতের বেশ কিছু প্রাণী এই রোগ থেকে মুক্ত এবং তারা রীতিমত বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে মৃত্যুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোতেই পারদর্শী। এই প্রাণী গুলো হল-কচ্ছপ, জেলিফিশ, কিছু প্রজাতির বড় শামুক, হাইড্রা, গলদা চিংড়ি ইত্যাদি।
প্রত্যেক প্রাণী একটা নির্দিষ্ট বয়সে যাওয়ার পর থেকে সে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয় অর্থাৎ মৃত্যুর হার বাড়তে থাকে, এটা প্রাণিজগতে খুব কমন ব্যাপার কিন্তু সবথেকে মজার বিষয় এই জীব গুলো একটা নির্দিষ্ট বয়স পার করার পর এদের মৃত্যুর হার কমতে থাকে, অর্থাৎ একটা প্রাপ্ত বয়স্ক কচ্ছপ আর একটি ২৫০ বছরের বুড়া (আমাদের হিসাবে) কচ্ছপ সব দিক থেকে হুবহু তরুণ কচ্ছপটির মতো। এই প্রাণীগুলো এটা কিভাবে করে তা বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা উঠে পড়ে লেগেছেন এবং তারা ভাবছেন কি করে এটা মানুষের ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায়, সামান্য কিছু ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছেন। এ কথা গুলো কল্পবিজ্ঞান (Science-Fiction) মনে হতে পারে অনেকের কাছেই কিন্তু বিষয়টা এখন দিনের আলোর মতই সত্য এবং স্বচ্ছ। উৎসাহীরা গুগল স্কলারিতে (Google Scholar) অনুসন্ধান করে দেখতে পারেন, এ সম্পর্কিত অনেক গবেষণা পত্র পাওয়া যাবে।