সরকারে থাকা না থাকা নিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও তার স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন আবার নতুন রূপ নিয়েছে। তাদেরকে ইদানীং কোনো রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে একত্রে দেখা যায় না। দলীয় অনেক অনুষ্ঠানে এরশাদ থাকলে রওশন থাকেন না। জাতীয় পার্টির শীর্ষ এ দুই নেতা সম্পর্কের এমন অবনতির প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে দলের মন্ত্রী-এমপি ও নেতাকর্মীদের মধ্যেও। এক পক্ষের নেতাকর্মীরা আরেক পক্ষের নেতাকর্মীর মুখোমুখি হতেও পছন্দ করেন না। অনেকটাই মুখ দেখাদেখি বন্ধের উপক্রম। জাতীয় পার্টি কার্যত এ দুই নেতার বলয়ে আলাদা নেতৃত্ব গড়ে উঠছে। এতে দলের অনেক ত্যাগী নেতাকর্মীই আস্তে আস্তে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন। এসব ত্যাগী নেতাকর্মীদের আশঙ্কা পার্টির শীর্ষ এ দুই নেতার মধ্যকার বিরোধ চলতে থাকলে জাপাকে চরম মাশুল গুনতে হবে।
এ বিরোধের আগুনে সম্প্রতি ঘি ঢালেন রওশন এরশাদ। গত ৬ জুলাই জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ নারীদের ‘শোপিচ’ বলায় সংসদে সমালোচনার মুখে পড়েন। ওই সময় তার পাশে বসা স্ত্রী বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ তার এ বক্তব্যের জন্য সংসদে দুঃখ প্রকাশ করেন। এরশাদের পক্ষে ক্ষমাও চান তিনি। রওশনের এ ক্ষমা চাওয়াকে ভালোভাবে নেননি এরশাদ। এ ক্ষমা চাওয়াকে এখতিয়ার বহির্ভূত উল্লেখ করে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন এরশাদ। তিনি বলেন, আমার ভুলে অন্য কারো ক্ষমা চাওয়ার অধিকার নেই।
জাতীয় পার্টির রওশনপন্থী এমপিদের সাথে এরশাদপন্থী মন্ত্রীদের মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। এ বিরোধের জের ধরে জাপা এমপিদের নির্বাচনী এলাকায় দলীয় মন্ত্রীরা সফরে গেলেও তাদের অবহিত করা হচ্ছে না। ফলে দলটিতে এখন সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে দুইটি ধারা স্পষ্ট রূপ নিয়েছে। বলতে গেলে এক পক্ষ আরেক পক্ষের কোনো অনুষ্ঠানেই থাকছে না। এ বিরোধ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সম্প্রতি গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে বিশিষ্ট রাজনীতিক ও কূটনৈতিকদের সম্মানে দেয়া এরশাদের ইফতার পার্টিতে রওশনের অনুপস্থিতিতে। পার্টির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এরশাদ উপস্থিত থাকলে থাকেন না রওশন। আবার রওশনের ডাকা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন না এরশাদও। পার্টির গুরুত্বপূর্ণ এ দুই নেতার এ ধরনের অনুপস্থিতি দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। কার্যত দলটি এ দুই নেতাকে ঘিরে আলাদা বলয় সৃষ্টি হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয় সংসদের সদ্যসমাপ্ত বাজেট অধিবেশনের শেষ দিকে এরশাদ ও রওশন প্রায় নিয়মিত উপস্থিত হলেও একে অপরের সাথে কথা বলতে দেখা যায়নি।
সরকারে থাকা না থাকা প্রশ্নে আবার নতুন করে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন পার্টির শীর্ষ দুই নেতা এরশাদ ও তার স্ত্রী সংসদের বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ। তবে তাদের মধ্যকার এ বিরোধ আগের অবস্থানের বিপরীত। এবার দলীয় মন্ত্রীদের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেয়ার জন্য সরব হয়ে উঠেছেন বিরোধী দলের নেতা রওশন নিজেই। আগে এরশাদ বাদ দেয়ার পক্ষে থাকলেও তখন রওশন ছিলেন বিপক্ষে। এ নিয়ে গত ৫ জুলাই রওশন এরশাদ বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের দুই জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদের সাথে এবং দলীয় সংসদ সদস্যদের সাথে।
বর্তমান সরকার গঠনের শুরুতে এরশাদ চেয়েছিলেন জাপা দলীয় মন্ত্রীরা মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসুক। আর তখন রওশন চেয়েছিলেন তারা মন্ত্রিসভায় থাকুক। এখন এরশাদ নিজেই চান তার দলের মন্ত্রীদের মন্ত্রিসভায় থাকা জাপার সদস্য সংখ্যা তিন থেকে বাড়িয়ে পাঁচ করতে। তিনি পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ছোট ভাই জি এম কাদের ও দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকেও মন্ত্রী করতে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছেন। আর রওশন চান জাপাকে সত্যিকারের বরোধী দলের ভূমিকা পালনের জন্য দলীয় মন্ত্রীদের মন্ত্রিসভা থেকে বের করে আনতে। নেতৃত্বের কোন্দলে এমন এক জটিল আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে এরশাদের জাতীয় পার্টি। ফলে এরশাদ-রওশনের মধ্যকার নেতৃত্বের এ দ্বন্দ্ব আবারো প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে।
জানা গেছে, বৈঠকে আওয়ামী লীগের দুই জ্যেষ্ঠ নেতাকে রওশন বলেছেন ‘আমরা (জাপা) শুধু বিরোধী দল হিসেবেই থাকতে চাই। সরকারে থাকা আমাদের ঠিক হচ্ছে না। দেশী-বিদেশী অনেকের সাথে আমার আলাপ হয়েছে, কেউ বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখছে না। আমাদের তো তিনজন মন্ত্রিসভায় রয়েছেন। আপনারা (সরকার) তাদেরকে পদত্যাগ করতে বলুন। তাহলে বিষয়টি আপনাদের (সরকারের) জন্যও ভালো হবে, আমাদের জন্যও ভালো হবে। আপনারা চিন্তা ভাবনা করুন, প্রধানমন্ত্রীর সাথেও কথা বলুন। আমরাও আমাদের দলের নেতাদের সাথে কথা বলব। আমাদের দলও চায় মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসতে। এ সময় রওশনকে আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, সরকারের এই পর্যায়ে এসে মন্ত্রিসভা থেকে জাপার বের হয়ে যাওয়াটা রাজনৈতিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত হবে বলে মনে হয় না। এ কথা ঠিক, বিষয়টি নিয়ে শুরুতে কিছু কথাবার্তা ছিল, বিতর্ক ছিল, অনেকে সমালোচনা করেছে। কিন্তু এত দিনে বিষয়টি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এ দুই নেতা রওশনকে এ-ও বলেছেন, মন্ত্রিসভা থেকে জাপার বের হয়ে আসার সময় এখনো আসেনি। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী নিজেও নাকি এখন চাচ্ছেন না জাপা এই মুহূর্তে মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে যাক। ফলে বিষয়টি নিয়ে আরো চিন্তা ভাবনা করতে তারা রওশনকে অনুরোধ করেছেন বলে বৈঠক সূত্রের দাবি।
অপর দিকে সম্প্রতি জাতীয় সংসদ ভবনের সেমিনার কক্ষে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ভেজাল প্রতিরোধে করণীয় নিয়ে মতবিনিময় সভা করেন রওশন এরশাদ। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না জাপার বেশির ভাগ এমপি। জানা গেছে, এরশাদের বারণ থাকায় ওই বৈঠকে কেউ উপস্থিত ছিলেন না। এ ছাড়া দলটির সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও এরশাদপন্থী এমপিরা উপস্থিত থাকছেন না। এ বিষয়ে সে দিনকার বৈঠকে উপস্থিত না থাকা এমপি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, আমার শরীর খারাপ থাকায় বৈঠকে উপস্থিত হতে পারিনি। এ বিষয়ে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, সরকারে জাপার মন্ত্রী থাকলে জনগণ তো আমাদের বিরোধী দল বলবে না। বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ অনেককেই মন্ত্রিত্ব ছাড়তে বলেন, এ জন্যই অনেকে বৈঠকে আসেন না। ম্যাডাম না থাকলে যে তারা কখনই এমপি হতে পারতেন না, এটা তাদের বোঝা উচিত।