‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ মেতে ওঠার দিন আজ। আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৬তম জন্মজয়ন্তী। ‘মম এক হাতে বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য’ নিয়ে যে কবি ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তিনি আবার বললেন, ‘আমি চিরতরে দূরে সরে যাবো/তবু আমারে দেব না ভুলিতে।’ এমন আস্থাপূর্ণ উচ্চারণ বাংলার আর কোনো কবির মুখে শোনা যায়নি। ক্ষণজন্মা এই কবির জন্মদিনটি উদযাপনে সরকারি উদযাপন কমিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, নজরুল ইন্সটিটিউট ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে নানা সংগঠন বিশদ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলা সাহিত্যের কাব্যভুবনে ধূমকেতুর মতো যার আবির্ভাব ঘটেছিল, যার দীপ্ত ছটায় উদ্ভাসিত হয়েছিল বাঙালি জাতির মন ও মনন। তিনি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে, পরাধীনতার বিরুদ্ধে, দরিদ্রতার বিরুদ্ধে ও ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে আজন্ম লড়াই- সংগ্রাম করে জাতিকে দিয়ে গেছেন অনেক কিছু। কিন্তু দীর্ঘদিন নির্বাক থেকে, উপেক্ষিত থেকে, আপন ভুবনে এক রাশ ক্ষোভ নিয়ে একাকী নিঃসঙ্গ বিচরণ করে ফিরে গেছেন রিক্ত হাতে।
বাংলা সাহিত্যে সাম্য, সংগ্রাম ও বিদ্রোহের কবি, বিরহ ও প্রেমের কবি জাতীয় নবজাগরণের দিশারী কাজী নজরুল ইসলাম। কবি নজরুলের বিদ্রোহ ছিল শোষণ-নির্যাতন, জুলুম-অত্যাচার, বিভেদ-বৈষম্য, অসত্য ও অসাম্যের বিরুদ্ধে। তাই তো তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন তার কবিতা, গান, নাটক, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চলচ্চিত্র ও ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে। শিশু বয়স থেকেই কঠিন জীবন সংগ্রামের বাস্তব উপলব্ধি আর পরাধীনতার গ্লানি নজরুলের মনমানসিকতায় যে তীক্ষ্ণ প্রভাব ফেলেছিল, তারই ধারাবাহিকতায় বাকরুদ্ধ হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি মাথা উঁচু করে সগর্বে দাঁড়িয়ে জানান দিয়েছেন নিজেকে। এতকিছুর পরও কবির সব সৃষ্টির মূলে ছিল ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই- নহে কিছু মহীয়ান’ এই আদর্শ।
অথচ তিনি আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামের যে পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন, সে পরিবারে বিদ্যা ও বিত্ত- কোনোটাই ছিল না। ছিল না সঠিক জন্মতারিখ রাখার রীতিও। বাবা কী করতেন, পরিবারের আয়-রোজগারের কী ব্যবস্থা ছিল, মা কীভাবে সংসার সামলেছেন- এসব কোনো তথ্যই এখন আর জানা যায় না। কে জানে তার বড় ভাই সাহেবজান তার চেয়ে ক’বছরের বড় বা ছোট ভাই আলী হোসেন ক’বছরের ছোট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাঙালি পল্টনে যোগদানের আগে কীভাবে কেটেছে নজরুলের শিশুকাল ও কৈশর- তারও সুস্পষ্ট তথ্যভিত্তিক ইতিহাস নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নজরুল কী করে হঠাৎ উল্কার মতো বাংলা সাহিত্য এবং সঙ্গীত জগতের মধ্যগগনে আবির্ভূত হয়ে পুরো আকাশকে প্রজ্বলিত করে তুললেন। ভীষণভাবে নাড়া দিলেন, কীভাবে ভেঙেচুরে দিলেন প্রচলিত বঙ্কিমী ও রাবীন্দ্রিক বলয়কে? কী করে তিনি দুখু মিয়া থেকে নজর আলী, নজর আলী থেকে নজরুল এসলাম, নজরুল এসলাম থেকে নজরুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম থেকে কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে হাবিলদার কাজী নজরুল এবং সবশেষে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে উঠলেন- সেই বিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বভাবে বিদ্রোহী, আপনভোলা, অতি সহজ-সরল, দরদি ও নিরহংকারী এই জীবনভর দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামী কবিকে আমরা বাংলা সাহিত্যে পেয়েছি বহুরূপী, বহু মূল্যবান, বহুমাত্রিক, বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী হিসেবে। শত প্রতিকূলতা, শত বিরোধিতা, শত সমালোচনা, নিরুৎসাহ, ভর্ৎসনা, প্রতিবন্ধকতা- কোনো কিছুতেই তার খোদাপ্রদত্ত প্রতিভাকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। বিশেষ করে হিন্দু কুলীন ঘরের কন্যা প্রমীলাকে বিয়ের পর তৎকালীন কবি-সাহিত্যিকরা (সবাই হিন্দু সম্প্রদায়ের) নজরুলকে সমাজচ্যুত করা থেকে শুরু করে তার দারিদ্র্য, তার শিক্ষা, তার পরিবার, তার ভাষা জ্ঞান, তার চর্চা, কাব্যে তার বিষয় নির্বাচনসহ এমন কিছু ছিল না, যার কঠোর ভাষায় নিন্দা করে টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়নি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। এ অবস্থায় নজরুলের বিস্ময়কর প্রতিভার টের পেয়েছিলেন ওই সময় প্রথম বাঙালি নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই তো আশীর্বাণী দিয়ে কবিকে বলেছিলেন, ‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু- আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু-’।
বাংলা সাহিত্যে যখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব সর্বগ্রাসী, ঠিক তখনই নজরুল সেই প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে স্বাতন্ত্র্য ধারার সূচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন সঞ্জীবনী গতির সৃষ্টি করেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী কবি তার সমগ্র লেখনীর মধ্যেই ‘সবার উপরে মানুষ সত্য- তাহার উপরে নাই’ এই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। ১৯৪১ সালের শেষের দিকে কবি যখন নন্দিনী চলচ্চিত্রের সঙ্গীত রচনা ও সুরারোপ নিয়ে ব্যস্ত তখন হঠাৎ তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। লুম্বিনী পার্ক ও রাচি মেন্টাল হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলে এক বছরেরও বেশি সময়। ’৫৩ সালে কবিকে পাঠানো হয় ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে। কিন্তু ততদিনে সবই শেষ। বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি। সেই ১৯৫৩ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত নির্বাক ও অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় অনেকটা অনাদরে নীরবে-নিভৃতেই কাটে অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিভার অধিকারী বিদ্রোহী নজরুলের জীবন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবির জন্মদিনে নির্বাক কবিকে ঢাকায় নিয়ে এসে তাকে জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। তার কবিতা ‘চল্ চল্ চল্- ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল-’কে তিনি সামরিক সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত করে কবিকে সম্মানিত করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তৎকালীন পিজি হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনে চিকিৎসারত অবস্থায় কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কবির সেই হৃদয় নিংড়ানো আকুতি ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই’ গানের সূত্র ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাকে কবর দেয়া হয়। এখনও নজরুলের লাখো ভক্ত তার সেই শেষের কবিতা ‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আমি আর জাগিব না, সারা দিনমান কোলাহল করি কারো ধ্যান ভাঙ্গিব না’- উচ্চারণে কবির প্রতি হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করেন।
ত্রিশালে নেই উৎসবের আমেজ : ত্রিশাল প্রতিনিধি খোরশিদুল আলম মজিব জানান, এবার কবির জন্মজয়ন্তীর মূল অনুষ্ঠান কুমিল্লায় হওয়ায় ত্রিশালে লক্ষ করা যাচ্ছে না উৎসবের আমেজ। তবুও অন্য বারের মতো ত্রিশালে কবির জন্মজয়ন্তী উদযাপন করতে প্রস্তুত কবির বাল্যস্মৃতিবিজরিত বিদ্যাপিঠ নজরুল একাডেমি মাঠের নজরুল মঞ্চ ও কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। জয়ন্তী ঘিরে আয়োজন করা হয়েছে দুটি ভেন্যুতে পৃথক তিনদিনের ব্যাপক অনুষ্ঠানমালা।
নজরুল স্মারক বক্তৃতা করবেন কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী। কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গাহি সাম্যের গান মঞ্চে ৩ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার প্রথম দিনে উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। নজরুলের জন্মজয়ন্তীতে যুগান্তর স্বজন সমাবেশ উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে বর্ণাঢ্য র্যালি অনুষ্ঠিত হবে।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাণীতে বলেছেন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। বাঙালির কর্ম, চিন্তা ও মননে কবির অবিনশ্বর উপস্থিতি জাতির প্রাণশক্তিকে উজ্জীবিত রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেছেন, মানবতা, সাম্য ও দ্রোহের কবি নজরুল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদের মূর্ত প্রতীক। অত্যাচার, নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। প্রধানমন্ত্রী কবির ১১৬তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত সব অনুষ্ঠানের সার্বিক সাফল্য কামনা করেন। জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে এক বাণীতে বলেন, বাংলাসাহিত্যের কাব্যভুবনে কাজী নজরুলের আবির্ভাব ঘটেছিল ধূমকেতুর মতো, যার দীপ্ত ছটায় উদ্ভাসিত হয়েছিল বাঙালি জাতির মন ও মনন।
ঢাকাসহ জাতীয় কবির স্মৃতিবিজড়িত ময়মনসিংহের ত্রিশাল এবং চট্টগ্রামে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করা হবে।