সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। গতকাল বৃহস্পতিবার নাফ নদে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। সকাল থেকেই বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গাদের কাফেলা বাড়তে থাকে। ভোর থেকেই তারা উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের দিকে যাওয়া শুরু করে। ইজিবাইক বা টমটম, সিএনজি অটোরিকশার পাশাপাশি হেঁটে শিবিরে আসতে থাকে তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছে, বুধবার ভোর থেকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত শিবিরে ঢুকেছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা।

মিয়ানমার থেকে এপারে আসা লোকজন বলছে, শুধু রোহিঙ্গা মুসলমান নয়, রাখাইনে সংখ্যালঘু হিন্দুদেরও নির্যাতন করা হচ্ছে।

নির্যাতনের কারণে এই প্রথমবারের মতো সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও দলে দলে দেশ ছাড়ছে। বুধবার রাতে প্রাণভয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে নারী-পুরুষ, শিশু মিলিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৪১২ জন উখিয়ার কুতুপালং এলাকার পশ্চিম হিন্দুপাড়ায় আশ্রয় নিয়েছে। সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অপেক্ষা করছে আরো দুই শতাধিক হিন্দু। তারাও বাংলাদেশে ঢোকার অপেক্ষায় রয়েছে।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ভাষ্য মতে, মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৮৬ জন হিন্দু। তাদের অধিকাংশই রাখাইনের মংডুর ফকিরাবাজার গ্রামের বাসিন্দা। এরই মধ্যে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে গতকাল আরো ১৮ রোহিঙ্গার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বুধবার গভীর রাতে শাহপরীর দ্বীপ মাঝের পাড়া এলাকাসংলগ্ন সাগরে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাবোঝাই আরেকটি নৌকাডুবিতে এই প্রাণহানি ঘটে। এ নিয়ে ওই নৌকাডুবির ঘটনায় ২০ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

সীমান্তে বাড়ছে রোহিঙ্গাদের ঢল : মিয়ানমারসংলগ্ন বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল বাড়ছেই। কোনোভাবেই তাদের সীমান্তে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। বুধবার রোহিঙ্গাদের দল স্রোতের মতো বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে—এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে রাখাইন রাজ্যের নানা স্থানে। এরপরই গতকাল ভোর থেকে বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গার স্রোত বাড়তে থাকে। নদী পেরিয়ে ভোর থেকে রোহিঙ্গারা নানাভাবে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে জড়ো হয়। রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ গবাদি পশু পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে এসেছে। এসব পশু নিয়ে সীমান্ত এলাকায় টানা-হেঁচড়ারও শেষ নেই। সীমান্তে এক শ্রেণির দুর্বৃত্ত দেশত্যাগী রোহিঙ্গাদের সব সম্বল কেড়ে নিচ্ছে। টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক হারুন সিকদার জানান, বৃহস্পতিবার ভোর থেকে নাফ নদে রোহিঙ্গার ঢল নেমে আসে। রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা এতই বেশি যে সীমান্তে তাদের ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছে, নাফ নদ থেকে উঠে দলে দলে রোহিঙ্গারা যাচ্ছে শিবিরের দিকে। বুধবার ভোর থেকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত শিবিরে ঢুকেছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা।

প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের রাখাইনে ৩০ স্থাপনায় হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাখাইন অঞ্চলে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’র বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করে। বিধিনিষেধ আরোপ করে এসব এলাকার লোকজনের চলাচলের ওপর। অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন স্টেট কাউন্সিল এ হামলায় বিদেশি এনজিওর হাত রয়েছে বলেও দাবি করেছে। ওই অঞ্চলে কর্মরত এনজিও তাদের কর্মীদের সেখান থেকে সরিয়ে নিয়েছে। সেখানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না কোনো গণমাধ্যমকে। এ অবস্থায় সেখানে আসলে কী হচ্ছে, তা স্পষ্ট জানা না গেলেও প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে ধোঁয়া, শোনা যাচ্ছে গুলির শব্দ।

আর সীমান্ত পেরিয়ে চলে আসছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা পরিবার। তাদের বেশির ভাগই বলছে, তারা কয়েক দিন ধরে পাহাড়, সীমান্ত পয়েন্ট ও ক্ষেতে-খামারে অবস্থান নিয়েছিল। অনেকের পেটেই দানাপানি পড়েনি। রোদ-বৃষ্টি সহ্য করতে হয়েছে। ওপারে মিয়ানমার সেনাবাহিনী গুলি ছুড়ছে, আর এপারে বিজিবি ঘিরে রেখেছে।

জানা গেছে, অনেক রোহিঙ্গা শিশু অর্ধাহারে-অনাহারে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শিবিরে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না তাদের। গতকাল সকালে কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পের সামনে টেকনাফ-কক্সবাজার প্রধান সড়কে মিয়ানমারের মংডু কোয়াংছিবং এলাকার নুর আংকিছ, তৈয়ুবা বেগমসহ জনাদশেক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা হয়। ৮২ বছর বয়সী মো. হোসেন এই প্রথম বাংলাদেশে এসেছেন। সঙ্গে এনেছেন আপন নাতি ও নাতবউকে। হোসেন বলেন, ‘জাপান-ব্রিটিশের যুদ্ধ দেখেছি। তখন আমি কিশোর। দেখেছি যুদ্ধবিমান উল্টাপাল্টা ঘুরে উড়তে। কিন্তু এবারের মতো নির্যাতন আর কখনো দেখিনি। গণহারে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া এখন মিয়ানমারের নিয়মিত ব্যাপার। ’

বিজিবির মহাপরিচালক গত ২৭ আগস্ট সীমান্ত পরিদর্শন ও জিরো পয়েন্টে অবস্থান নেওয়া রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শেষে ঘুনধুম বিওপি ফাঁড়িতে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।

তবে বেশ কয়েক দিন সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঠেকিয়ে রাখা গেলেও শেষ পর্যন্ত বুধবার সকাল থেকে শত শত রোহিঙ্গাকে কুতুপালং শিবিরে ঢুুকতে দেখা গেছে।

দেশছাড়া করা হচ্ছে হিন্দুদেরও : মিয়ানমার থেকে আসা লোকজন জানিয়েছে, এর আগে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের অত্যাচার-নির্যাতন করা হলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন নির্যাতনের শিকার হয়নি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন।

রাখাইনের কুলালপাড়ার বকুল বালা জানান, কিছু সশস্ত্র লোক তাদের গ্রামে ঢুকে অত্যাচার চালায়। একপর্যায়ে তাঁর স্বামী কালু রুদ্র, কন্যা সন্ধ্যাবালা ও নাতি বাপ্পুকে তুলে নিয়ে যায়। পরে খবর পেয়েছি নির্যাতন চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে।

একই এলাকার বিজয় রাম পাল জানান, তিনি মংডুর চিকনছড়ি গ্রামে হালচাষ করতেন। কিন্তু সহিংসতা শুরুর পর থেকে তাদের গ্রামেও নিরীহ হিন্দুদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতনের পাশাপাশি ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। প্রাণ ভয়ে তিনি কয়েক দিন পাহাড়ে লুকিয়ে ছিলেন।

রাখাইনের চিকনছড়ি গ্রামের তপু রুদ্র বলেন, ‘আমার স্বামী কানু রুদ্রকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। উপায় না দেখে অন্যদের সঙ্গে চলে এসেছি বাংলাদেশে। মংডু এলাকার কোয়াছং হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা দীজেন্দ্র হানান ও তাঁর স্বজনরা থাকতেন ফকিরাবাজারে। সেখানকার ৮৬ জনকেই হত্যা করেছে সশস্ত্র লোকজন। ’