রোববার সন্ধ্যায় ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশের নানা শ্রেণি পেশার লোকদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বক্তৃতায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সমস্যা, স্থলসীমান্ত চুক্তি, সার্ক ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথা বলেছেন মোদি। বক্তৃতার একটি বড় অংশজুড়ে মোদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করেন। এ ছাড়া বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও রাজনীতির বিভিন্ন দিকও তাঁর বক্তৃতায় উঠে আসে। মোদির বক্তৃতায় উঠে আসা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো:
ধারাবাহিকভাবে ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছোট ব্যাপার নয়: বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে মোদি বলেন, বিশ্বে বিকাশমান দেশগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু আমাদের মতো গরিব দেশের ওপর নজর কম থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ এই জায়গা থেকে খুব কম সময়ে বের হয়ে এসেছে। এখানে বারবার রাজনৈতিক সংকট এসেছে। কঠোর লড়াই ও নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দারুণ কাজ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দিয়ে মোদি বলেন, ‘তিনি একটিই লক্ষ্য বানিয়েছেন, সেটি সমৃদ্ধি। এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।’ তিনি আরও বলেন, ধারাবাহিকভাবে ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছোট ব্যাপার নয়। যে ভিত্তি এখন তৈরি হচ্ছে, আসন্ন দিনে এটি এখানকার ভবিষ্যৎকে তৈরি করবে।
বাংলাদেশের যুবশক্তির কথা উল্লেখ করে মোদি বলেন, বাংলাদেশের কাছে ৬৫ শতাংশ জনসংখ্যার বয়স ৩৫ বছরের নিচে। তিনি বলেন, এটি যুবশক্তিতে ভরপুর একটি দেশ। যে দেশে এত যুবক ও এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন আছে সে দেশের বিকাশ থমকে থাকতে পারে না।
সাম্রাজ্যবাদ নয়, উন্নয়নবাদ: বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে মোদি বলেন, সময় বদলেছে, বিশ্ব বদলেছে। একটা সময় ছিল যখন সাম্রাজ্যবাদ দেশের শক্তির পরিচয় ছিল। কে কত অত্যাচার করতে পারে, সেটি শক্তি হিসেবে মাপা হত। এখন সাম্রাজ্যবাদকে কোনো স্থান দেওয়া যায় না। আজ সমৃদ্ধিবাদের প্রয়োজন, সাম্রাজ্যবাদ না।
স্থলসীমান্ত চুক্তি মনকে যুক্ত করেছে: স্থলসীমান্ত চুক্তি নিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেন, খুব কম লোক এটি চিন্তা করেছে যে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্থলসীমান্ত চুক্তি হবে। তিনি বলেন, এটি শুধুমাত্র জমির সমস্যার সমাধান নয়, এটি সে চুক্তি যা মনকে যুক্ত করেছে। মোদি বলেন, আজ একটি স্থানীয় পত্রিকায় সীমান্তচুক্তিকে বার্লিন দেয়াল ভেঙে পড়ার সঙ্গে তুলনা করে সংবাদ করতে দেখেছেন। তিনি বলেন, অন্য দেশ হলে এ নিয়ে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার রাস্তা খোঁজা হতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে মোদি বলেন, এটি সে বিশ্ববিদ্যালয় যা বাংলাদেশকে জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা দিয়ে ভরিয়ে তুলেছে। প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে জ্ঞান বৃদ্ধির কাজ এ বিশ্ববিদ্যালয় করেছে। ভবিষ্যতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার কথাও বলেন তিনি।
সবাই চলুক না চলুক কয়েকজন তো সঙ্গে চলেছে: সার্কের দেশগুলোর সংযুক্তি নিয়ে আলোচনায় নরেন্দ্র মোদি বলেন, এখানকার সাতটি দেশের পাঁচটির সঙ্গে সমুদ্র আছে। একসঙ্গে কাজ করলে দেশগুলো অনেক এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব। তিনি বলেন, ‘নেপালে সার্ক সম্মেলনের সময় আমরা প্রস্তাব করেছিলাম, সংযোগ ও যোগাযোগের বিষয়ে। আমরা সব দেশ যাতে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারি। কিন্তু সবাই বাংলাদেশ নয়। আমার গাড়ি হয়তো লাইনে যায়নি, তাই বলে কি বসে থাকব? আমরা সার্কে হয়তো পারিনি, কিন্তু বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান বড় মাপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দক্ষিণের দেশগুলো এখন এগিয়ে যেতে পারবে। সবাই না চলুক কয়েকজন তো সঙ্গে চলেছে।’
মহাকাশেও একসঙ্গে: ভারতের প্রধানমন্ত্রী মহাকাশেও বাংলাদেশের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, গতকাল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একসঙ্গে কাজ করার কথা বলেছেন।
নারী অগ্রগতির প্রশংসা: বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রগতির প্রশংসা করেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, মহিলাদের ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি, তাতে হয়তো এখানকার পুরুষদের হিংসা হয়। এখানকার প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহউপাচার্যও নারী। এটি শুনে গর্ব হওয়ার কথা বলেন তিনি। মোদি বলেন, আজও বিশ্বের অনেক দেশে মহিলাদের রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে স্বীকার করার মানসিকতা নেই। অথচ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভারত, থাইল্যান্ডে বারবার এটি হয়েছে।
তিস্তার পানির মানবিক সমাধান: মোদি বলেন, পানি, বাতাস আর জল—এগুলোর জন্য কোনো ভিসার দরকার নেই। পানি রাজনীতির বিষয় হতে পারে না। এগুলোর আলোচনা মানবিক মূল্যে দিয়ে করতে হবে। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে বিশ্বাস রাখতে হবে। বিশ্বাস হারালে চলবে না। এ সমস্যার সমাধানে ভারতের চেষ্টা চলবে বলে জানান তিনি।
সীমান্ত সমস্যা দুঃখজনক: সীমান্ত সমস্যা নিয়ে মোদি বলেন, কখনো কখনো সীমান্তে এমন কিছু ঘটনা হয়, যা নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হয়। এটি সবার জন্য দুঃখের বিষয়। তিনি বলেন, গুলি যেখান থেকে চলুক। এতে গরিব মানুষ মারা যায়। যারা আমাদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করতে চায়, তারা যাতে সুযোগ না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশের ভূমিকায় প্রশংসা: জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গে মোদি বলেন, জঙ্গিবাদকে কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তা কেউ জানে না। জাতিসংঘও সে পথ দেখাতে পারছে না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নারী হয়েও এ নিয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানোর কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আমরা যে সম্প্রদায়ের হই না কেন, ঈশ্বর বা আল্লাহ, যাই বিশ্বাস করি বা না করি। কিন্তু মানবতাবাদী শক্তির এক জোট হওয়া খুবই দরকার।
নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘের সমালোচনা: নরেন্দ্র মোদি বলেন, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ছয়জনের মধ্যে একজন ভারতের। শান্তিরক্ষা বাহিনীতেও ভারত সবচেয়ে শৃঙ্খলার সঙ্গে কাজ করে। কিন্তু ভারত নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য নয়। মোদি প্রশ্ন তোলেন, এটি কী ধরনের চিন্তাভাবনা?
আপনাদের প্রধানমন্ত্রী ও আমার চিন্তাভাবনা এক: ভারতের ও বাংলাদেশের লক্ষ্য প্রসঙ্গে নরেন্দ্র মোদি বলেন, আপনাদের প্রধানমন্ত্রী ও আমার চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণভাবে এক। আমার একটি ভাবনা, উনারও তা। উন্নতি, উন্নতি।
নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘কারও সাহায্য নিয়ে কাজ করলে দুই বছর লাগবে, সাহায্য না নিলে পাঁচ বছর লাগবে। কিন্ত আমরা হাল ছেড়ে দেব না। সমৃদ্ধির পথে চলব।’ মোদি বলেন, ‘আপনার বাড়ি যত শক্তিশালী হোক। প্রতিবেশীর দেয়াল মজবুত না সেটি টেকসই হবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের শক্তি নিয়ে একসঙ্গে হতে হবে। যাতে যেকোনো সংকট মোকাবিলা করা যায়।
বক্তৃতার শেষ দিকে মোদি বাংলাদেশের সফরটি খুব কম সময়ের হয়ে গেল বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, সফর মাত্র শুরু হলো। বাংলাদেশের মানুষকে আমি কখনো ভুলতে পারব না। আমি আরও আবার একবার বাংলাদেশে আসতে চাই।’