মামলায় জর্জরিত বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন থেকে শুরু করে তৃণমূল ইউনিটের নেতা পর্যন্ত সবাই মামলার জালে বন্দী। কেউ জেলে, কেউবা মামলার ঘানি কাঁধে নিয়ে বেড়াচ্ছেন পালিয়ে। জামিন পেতে আদালতের দরজায় দাঁড়িয়ে এখন বহু নেতাকর্মী। জামিন হওয়া-না-হওয়ার শঙ্কায় আত্মগোপন থেকেও বের হতে পারছেন না অনেক শীর্ষ নেতা। নতুন করে বিভিন্ন জায়গায় গ্রেফতার অভিযান শুরু হওয়ায় তৈরি হয়েছে আতঙ্ক।
বিএনপির নেতারা বলছেন, দলের কোনো কর্মসূচি নেই। অথচ নেতাকর্মীরা বাড়িঘরে থাকতে পারছেন না। নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। তারা বলছেন, সরকার বিএনপিকে মামলা-অস্ত্র প্রয়োগ করে ঘায়েল করতে চায়। সিনিয়র নেতাদের নির্বাচনে অযোগ্য করতে দ্রুত চার্জশিট দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ তাদের।
জানা গেছে, সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ২০ হাজারেরও বেশি। এতে আসামি রয়েছেন কমপক্ষে পাঁচ লাখ। কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে মামলা দেড় শতাধিক। খোদ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও ১৮টি মামলার খড়গ ঝুলছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচারপ্রক্রিয়া চলছে। নাইকো ও গ্যাটকো মামলাও সচল হয়েছে। এসব মামলায় সাজা দিয়ে সরকার বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার নীলনকশা করছে বলে বিএনপি ইতোমধ্যে অভিযোগও করেছে।
দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও এ পর্যন্ত অন্তত অর্ধশত মামলা করা হয়েছে। একইভাবে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ৮৩টি মামলার আসামি হয়ে কারাগারে। আওয়ামী লীগের দুই মেয়াদে ষষ্ঠবারের মতো জেল খাটছেন বিএনপির এ নেতা।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, জিয়া পরিবারসহ সিনিয়র নেতাদের নির্বাচন ও রাজনীতি থেকে দূরে সরাতেই ক্ষমতাসীন সরকার প্রতিনিয়ত তাদের মিথ্যা মামলায় জড়াচ্ছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এসব মামলায় অভিযোগপত্র জমা নিয়ে বিএনপিতে নানাভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। উদ্দেশ্য, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ সিনিয়র নেতাদের সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা।
তারা বলছেন, সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন যাতে গড়ে উঠতে না পারে সে জন্য বিএনপিতে ভাঙন সৃষ্টির পাঁয়তারাও চলছে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ও পরে একাধিকবার এ চেষ্টা চালানো হয়। একইভাবে ২০ দলীয় জোটের মধ্যেও সন্দেহ অবিশ্বাস সৃষ্টি করতেও অপকৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু এসব করেও সরকারের শেষ রক্ষা হবে না।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ৫ জানুয়ারি থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে নাশকতার অভিযোগে এক হাজার ৭৭৫টি মামলা দায়ের করা হয়। এ সংক্রান্ত মামলায় ১৮ হাজার ৩৮ জনকে গ্রেফতার করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। দায়েরকৃত মামলাগুলোর মধ্যে ১২০টির চার্জশিট দেয়া হয়েছে। অভিযোগপত্র দেয়া মামলাগুলোর মধ্যে ডিএমপির ৪০টি এবং অন্যান্য মহানগর এলাকার ৮০টি মামলা রয়েছে। তদন্তাধীন রয়েছে এক হাজার ৬৫৪টি মামলা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত নাশকতার অভিযোগে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এক হাজার ৭৭৫টি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ সদর দফতরসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে পাঠানো হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। জন নিরাপত্তা ট্রাইব্যুনালে বিচার হচ্ছে নাশকতা মামলার।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির যুগ্ম-সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন নয়া দিগন্তকে বলেন, দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সরকার বিএনপি জোটের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নিতেই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নতুন নতুন মামলায় জড়াচ্ছে।
জানা গেছে, গত দুই দফা আন্দোলনে দলের সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে অন্তত চার শতাধিক মামলা। জিয়া পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও রয়েছে প্রায় অর্ধশত মামলা। আসামিদের অনেকে এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার নতুন মামলায় গ্রেফতারের আতঙ্কে গা-ঢাকা দিয়েছেন হাজার হাজার নেতাকর্মী। এসব মামলায় গাড়ি পোড়ানো, ভাঙচুর, জানমালের ক্ষতি, নাশকতার হুকুম দেয়া, বেআইনিভাবে সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া, ককটেল বিস্ফোরণ, দুর্নীতি, মানহানি, রাষ্ট্রদ্রোহ, হত্যাচেষ্টা, নাশকতা সৃষ্টি বা চেষ্টা, পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা, পুলিশের কাজে বাধা দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। অনেক মামলায় কিছুসংখ্যক আসামির নাম উল্লেখ থাকলেও বেশির ভাগই থাকে অজ্ঞাতনামা আসামি।
দলীয় সূত্র জানায়, মামলার ঘানি টানতে গিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের নাভিশ্বাস উঠছে এখন। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নিঃস্ব প্রায়। দল থেকেও কর্মীরা তেমন সহায়তা, বিশেষ করে আইনি সহায়তা পাচ্ছে না বললেই চলে। সার্বিকভাবে এর প্রভাব পড়ছে সাংগঠনিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও। থমকে আছে দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়াও।
বিভিন্ন মামলায় সিনিয়র নেতাদের মধ্যে এখনো কারাগারে রয়েছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, শামসুজ্জামান দুদু, রুহুল কবির রিজভী, গাজীপুরের মেয়র অধ্যাপক আবদুল মান্নান, সিলেটের মেয়র আরিফুল হকসহ অনেকেই। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কয়েক দিন আগে অভিযোগ করেছেন, তাদের ৫০ হাজার নেতাকর্মী এখনো জেলে রয়েছেন। যদিও এ অভিযোগ সরকারের তরফ থেকে অস্বীকার করা হয়েছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো: শাহজাহান নয়া দিগন্তকে বলেন, বিএনপির এ কঠিন সময় থাকবে না। প্রয়োজন শুধু সরকারের নিষ্ঠুর নির্যাতন ও বর্বরতম অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ নেতাকর্মীদের পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকা। এখনো দল এবং দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি দলের নেতাকর্মীদের রয়েছে অবিচল আস্থা এবং জনগণের ব্যাপক সমর্থন। প্রয়োজন শুধু সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করা।