ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর নিয়ে সরকারে যে উচ্ছ্বাস ছিল তাতে অনেক সম্ভাবনার কথাই বলছিলেন অনেকে। প্রধানমন্ত্রীর গণমাধ্যম উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেছিলেন, দুই কিংবদন্তী নেতা মুখোমুখি হলে অলৌকিক কিছু ঘটলেও ঘটতে পারে!
তবে শেষ বেলায় এসে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক ছাড়া চমক দেয়ার মতো কিছু ঘটেনি শনিবার। তিস্তা চুক্তি হবে না এমন শর্তেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোদির সফরসঙ্গী হয়েছেন। তারপরও সবার আশা ছিল, শেষ পর্যন্ত অবাক করবেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ইকবাল সোবহানের ভবিষ্যদ্বাণী ফলেনি। অবশ্য যৌথ প্রেসব্রিফিংয়ে আশ্বাস দিয়েছেন মোদি।
এদিকে গতকাল শুক্রবার মোদির সফর প্রসঙ্গে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী জানিয়েছিলেন, ভারতকে অধিক সুবিধা দিয়ে ট্রানজিট সংক্রান্ত নানা চুক্তি হলেও তিস্তা হচ্ছে না।
এটি সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা কি না, সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। শিগগিরই আরো ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে। সুতরাং আমরা কিছুই পাচ্ছি না এটি ঠিক না।’
কিন্তু মন্ত্রীর এ বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেল না। শনিবার ভারতের দুই বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও বিদ্যুৎ আমদানি সংক্রান্ত চারটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা থাকলেও শুধু কেন্দ্র নির্মাণ সংক্রান্ত দু’টি চুক্তি সই হয়েছে। এতে দুটি ভারতীয় কোম্পানি সাড়ে চার বিনিয়ন ডলার বিনিয়োগের সুযোগ পাবে।
এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রস্তাবিত দুই বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনে ভারতের বৃহত্তম শিল্প গ্রুপ রিলায়েন্স ও আদানির সঙ্গে দুইটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। কিন্তু বিদ্যুৎ আমদানি সংক্রান্ত কোনো চুক্তি হয়নি। যদিও এই দুই ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানি সংক্রান্ত দুটি এমওইউ হওয়ার কথা ছিল।
গত মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের পর গত এক সপ্তাহ থেকে বিদ্যুৎ বিভাগ চারটি এমওইউ সইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও জানিয়েছিলেন, শনিবার চারটি সমঝোতা চুক্তি হবে। এমনকি মন্ত্রণালয়ের অনেক তথ্য বিবিরণীতেও এ বিষয়টি উল্লেখ ছিল।
কিন্তু সকাল ১১টায় ঢাকার বিদ্যুৎ ভবনে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে পিডিবি ও দুই কোম্পানির মধ্যে মাত্র দুটি এমওইউ হয়। আমদানি সংক্রান্ত এমওইউ দুটি হলো না কেন এ বিষয়ে খোদ বিদ্যুৎ বিভাগের অনেক কর্মকর্তাও কিছু জানাতে পারেননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানান, বেসরকারি কোম্পানি হিসেবে রিয়েলেন্স ও আদানি যদি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে চায় তবে সেদেশের সরকারের অনুমোদন লাগবে। এখনো সে রকম কোনো অনুমতি না পাওয়ায় আমদানি সংক্রান্ত এমওইউ হয়নি।
উল্লেখ্য, শনিবার সম্পাদিত সমঝোতা অনুসারে, আদানি গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আদানি পাওয়ার বাংলাদেশের মহেশখালী অথবা অন্য কোনো সুবিধাজনক জায়গায় ১৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে। জ্বালানি হবে আমাদনিকৃত কয়লা। এতে দেড় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হতে পারে।
অন্যদিকে রিলায়েন্স গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স পাওয়ার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ভিত্তিক ৩০০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কোথায় স্থাপন করা হবে তা এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। এতে তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হবে বলে জানিয়েছে রিলায়েন্স ।
বিদ্যুৎ জ্বালানি সংক্রান্ত বিশেষ আইনের আওতায় দরপত্র ছাড়াই বৃহৎ এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হবে। আর যে দুটি বিষয়ে সমঝোতা হওয়ার কথা ছিল তার একটি হলো আদানি পাওয়ার কর্তৃক ভারতের অভ্যন্তরে উপযুক্ত স্থানে আদানি পাওয়ারের স্থাপিতব্য প্রতিটি ৮০০ মেগাওয়াটের দুইটি কয়লা ভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ আমদানি করবে ।
অন্যটি হলো রিয়েলেন্স পাওয়ার কর্তৃক ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে স্থাপিতব্য ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কালাই-২ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে ৯৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করবে বাংলাদেশ। এ দুই ক্ষেত্রেই পিডিবির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল।
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করছেন, ভারতীয় কোম্পানি দুটি তাদের স্বার্থ ঠিকই দেখেছে। বাংলাদেশে নিজেদের প্রকল্প বাগিয়ে নিয়েছে। কিন্তু নিজের দেশে থেকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ আমাদনি সংক্রান্ত বিষয়টিকে ভারতীয় কোম্পানিগুলো গুরুত্ব দেয়নি।
উল্লেখ্য, ভারতের সরকারি খাত অনেক আগে থেকে বাংলাদেশে কাজ করছে। দেশটির জাতীয় কোম্পানি ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি) পিডিবি এর সঙ্গে যৌথভাবে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। এছাড়া বাংলাদেশ এখন ভারত থেকে দৈনিক ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে। এরমধ্যে ২৫০ মেগাওয়াট সরকারীখাত থেকে আর ২৫০ মেগাওয়াট বেসরকারিখাত থেকে আমদানি করা হচ্ছে। দেশটির বেসরকারি খাত থেকে আরো ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানির আলোচনা চলছে। তবে এবারই প্রথম ভারতীয় বড় কোন শিল্প উদ্যোক্তা দেশের বিদ্যুৎ খাতে সরাসরি বিনিয়োগ করছে।