জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত পলাতক আসামি অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ রাশেদ চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্ল–ম বার্নিকাট বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই তথ্য জানিয়েছেন। তবে ঠিক কবে রাশেদ চৌধুরী এই রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। স্পষ্ট করে তিনি কিছু বলেননিও।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিকাল তিনটার দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান। সেখানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক করেন। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বর্তমান অবস্থান, তাদের ফিরিয়ে আনা, যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে আনা এবং জিএসপি ইস্যুতে আলোচনা হয়। বৈঠকের পর বার্নিকাট অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কোনো কিছুই বলেননি। জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত আমাকে জানিয়েছেন যে, বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছে। আমি বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেছি। রাষ্ট্রদূত বলেছেন, বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়াধীন।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশরাফুজ্জামান খান নামের একজন যুদ্ধাপরাধী রয়েছেন। আমি তাকে ফেরত পাঠানোর জন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ করি। জবাবে রাষ্ট্রদূত এই যুদ্ধাপরাধীর ব্যাপারে কিছু কিছু তথ্য আমাদের কাছে চেয়েছেন। আমরা শিগগিরই এসব তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাঠিয়ে দেব।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি নূর চৌধুরী বর্তমানে কানাডায় রয়েছে। তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য আইনি ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জোর দিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আমরা বদ্ধপরিকর। বঙ্গবন্ধুর একজন আদর্শের সৈনিক হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী যে, বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের আমলেই পলাতক খুনিদের অন্তত একজনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হব। তিনি খুনিদের ফেরত আনতে ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট জারি রয়েছে বলেও জানান।
রাশেদ চৌধুরীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক থাকার বিষয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের গত আমলে বাংলাদেশ সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকায় তার অবস্থান সংক্রান্ত খবর প্রকাশের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিগত সরকারের আমলে তাকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ জানানো হয়। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে এলেও এ বিষয়ে বাংলাদেশের অনুরোধের বিষয়টি তোলা হয়। হিলারি তখন দেশে ফিরে গিয়ে বিষয়টি আন্তরিকভাবে দেখবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। তারপর আর কোনো সাড়া নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। কিন্তু কোনো কোনো রাজ্যে মৃত্যুদণ্ড নেই। এখন তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দৃশ্যত রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশের কাছে ফিরিয়ে না দেয়ার ইঙ্গিতই দিয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনতে সব রকমের কৌশলই গ্রহণ করা হবে। এক্ষেত্রে আইনি ফার্ম নিযুক্ত করে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি চলবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় দৃশ্যত তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ায় পলাতক আসামি নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশের কাছে ফেরত পাঠাবে না কানাডা। কারণ উত্তর আমেরিকার এই দেশটিতে মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান নেই। আরেক আসামি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দেয়ার জন্য বাংলাদেশের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র এখনও পর্যন্ত কোনো সাড়া দেয়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্র তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে। পলাতক অপর চার আসামি কোথায় আছে তার কোনো হদিস নেই। এই পরিস্থিতিতে পলাতক খুনিদের সহসাই ফিরিয়ে আনার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠাবে না কানাডা : জানতে চাইলে কানাডায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার কামরুল আহসান টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। একটাই সমস্যা, কানাডীয় আইনে কারও মৃত্যুদণ্ড হলে তাকে তারা হস্তান্তর করে না। তিনি আরও বলেন, আমরা আইনজীবী, কানাডার জনপ্রতিনিধি এবং সরকারের মাধ্যমে চেষ্টা করছি।
কানাডায় অবস্থান করছেন এমন একজন বাংলাদেশী যুগান্তরকে বলেছেন, কানাডায় অনেক সময় জনমতের চাপে আইন পরিবর্তন করে থাকে। এক্ষেত্রে কানাডায় অবস্থানকারী বাংলাদেশীরা চাপ সৃষ্টি করলে নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠাতে পারে। কানাডায় বাংলাদেশী আছেন মাত্র এক লাখ। তাদের অনেকেই আবার তৃতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশী। তারা নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর ইস্যুর চেয়ে এখানে টিকে থাকার সংগ্রামে সময় পার করছেন বেশি। তাছাড়া কানাডায় এখানকার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এমন বাংলাদেশী নেই বললেই চলে। বাংলাদেশী সম্প্রদায় আবার রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত।