পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিম্ন আদালতের দেওয়া ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ বিডিআর জওয়ানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। যে ১৩ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়নি, তাদের মধ্যে চারজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। আর মৃত্যুদণ্ড হ্রাস করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে আট জওয়ানকে। আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় বাকি একজনের মৃত্যু হয়।

এদিকে নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়েছে। তবে নিম্ন আদালতে খালাস পাওয়া ৩১ জওয়ানকে নতুন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। এখন মোট যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৮৫ জনে। এ ছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডপ্রাপ্ত ২০০ জনের সাজা বহাল রয়েছে।

হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ গতকাল সোমবার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর এই রায় ঘোষণা করে। রায়ে বলা হয়েছে, অপরাধের ইতিহাসে পিলখানা হত্যাকাণ্ড এক নজিরবিহীন ঘটনা। ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ বেসামরিক নাগরিককে বিডিআর বিদ্রোহীরা নৃশংসভাবে হত্যা করে যে জঘন্য অপরাধ করেছে তা খুবই মর্মান্তিক, বিভীষিকাময়, নারকীয় ও ভয়ঙ্কর। এই অপরাধ সভ্য সমাজের মানুষের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের (জওয়ানদের) অপরাধ বর্বরতা ও সভ্যতার সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

রায়ে বলা হয়, মামলার তথ্য-প্রমাণ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত নতুন সরকারকে উত্খাত করার গভীর ষড়যন্ত্র ও নীলনকশা ছিল। ওই ষড়যন্ত্রে অভ্যন্তরীণ ইন্ধনের পাশাপাশি আবার বাইরের যোগসূত্রও থাকতে পারে।

বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বে বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ জনাকীর্ণ আদালতে এ রায় ঘোষণা করেন। দু’দিন ধরে এ রায় ঘোষণা চলে।

২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত পিলখানা হত্যা মামলার রায়ে বিডিআরের তত্কালীন উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) তৌহিদুল আলমসহ ১৫২ জওয়ানকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় ২৫৬ জনকে। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৭ জন।

১৫২ জনকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের ওই রায় নিশ্চিতকরণে মামলাটি ডেথ রেফারেন্স আকারে হাইকোর্টে আসে। পাশাপাশি ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিরা বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। পাশাপাশি নিম্ন আদালতে খালাস পাওয়া ৬৯ জওয়ানের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ৩৭০ কার্যদিবস ধরে হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে এই ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর শুনানি চলে। শুনানি শেষে গত ১৩ এপ্রিল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়। চলতি মাসের ২৬ নভেম্বর বৃহত্তর বেঞ্চের রায় ঘোষণা শুরু হয়।

গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো রায় ঘোষণার জন্য সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে এজলাসে আসেন তিন বিচারক। বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারক মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার বিডিআর বিদ্রোহ ও সেনা কর্মকর্তা নিহতের ঘটনার ধারাবাহিক চিত্র আদালতে তুলে ধরেন। এতে কিভাবে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে তাও উঠে আসে। পাশাপাশি সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা ও তাদের স্বজনদের পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে সেটিও সাক্ষীদের সাক্ষ্য উদ্ধৃত করে তিনি আদালতে পাঠ করে শোনান। এ সময় এজলাস কক্ষে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা।

পর্যবেক্ষণ শেষে বেলা আড়াইটার দিকে সাজার অংশ ঘোষণা করা হয়। ওই ঘোষণায় হাইকোর্ট প্রথমে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের আপিলের রায় ঘোষণা করেন। ওই রায়ে ১৮২ জনকে ১০ বছর, ২ জনকে ১০ ও ৩ বছর (উভয় সাজা একসঙ্গে চলবে), ৮ জনকে ৭ বছর, ৪ জনকে তিন বছর এবং ২৯ জনকে খালাস দেওয়া হয়। নিম্ন আদালত এদেরকে সর্বোচ্চ ১৩ বছর থেকে ৩ বছর পর্যন্ত সাজা দিয়েছিল। দণ্ডবিধির ৩৮২ ধারায় দেওয়া ওই দণ্ড সংশোধন করেছে হাইকোর্ট। আদালত বলেছে, দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে থাকায় দণ্ড সংশোধন করে দেওয়া হলো। একইসঙ্গে আসামিদের জরিমানা হ্রাস করে ২০ হাজার টাকা ধার্য করে দেওয়া হয়েছে। তবে ২৮ জন আপিল না করায় তাদের দণ্ড বহাল রয়েছে।

আসামি পক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, স্বল্প মেয়াদে এসব দণ্ডপ্রাপ্তদের অধিকাংশ দীর্ঘদিন ধরে সাজা খাটছেন। ফলে অনেকে মুক্তি পেয়ে যাবেন। এরপরই যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিলের রায়ে ১৪৬ জনের দণ্ড বহাল রেখে আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১২ জনকে খালাস দেওয়া হয়। তবে আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় মারা গেছেন দু’জন।

নিম্ন আদালতে খালাস পাওয়া ৬৯ জন জওয়ানের ফাঁসি চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। হাইকোর্ট রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন, ৪ জনকে ৭ বছর করে কারাদণ্ড এবং ৩৪ জনকে খালাস দেয়। সর্বশেষ ১৫২ জনের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায় ঘোষণা করে হাইকোর্ট। রায়ে ডিএডি তৌহিদুল আলম, ডিএডি নাসির উদ্দিন খান, ডিএডি জলিল, সেপাই সেলিম রেজা, গোফরান মল্লিকসহ ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে আদালত। এছাড়া মোট খালাস পেয়েছে ৪৫ জন আসামি।

রায় ঘোষণাকালে আদালত প্রাঙ্গণ ও কক্ষের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন দণ্ডপ্রাপ্ত জওয়ানদের আত্মীয়-স্বজন। হাইকোর্ট যখন দণ্ড ঘোষণা করছিলেন তখন বাইরে থেকে ভেসে আসছিল স্বজনদের কান্নার শব্দ। অনেকে রায় শুনে ভেঙে পড়েন কান্নায়। তবে স্বজনদের অনেকেই জানিয়েছেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন।