চলতি বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা

0
525

বিগত কয়েক বছরের মতো চলতি বছরেও বাজেট বরাদ্দের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

কারণ জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি এ ৮ মাসে বাজেটের টাকা ব্যয় হয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ সম্পূর্ণ বাজেট বাস্তবায়ন করতে জুনের মধ্যে সরকারকে ব্যয় করতে হবে এক লাখ ৮৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকা।

ওই হিসাবে প্রতি মাসে এ ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৬ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদদের মতে, অর্থবছরের শুরুতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বড় আকারের বাজেট ঘোষণা দেয়া হয়। বছরের মাঝামাঝিতে তা কাটছাঁট করে আকার ছোট করা হয়।

পাশাপাশি বাজেটে বরাদ্দ ব্যয়ের হার বেশি দেখাতে বছরের শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করে খরচ করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এতে ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় দ–র্নীতি, অপচয় ও অপব্যবহার।

আর কোনোভাবেই নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না কাজের গুণগত মান। এছাড়া একই সময়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে হাত দেয়ায় বেড়ে যায় জনদুর্ভোগও।

চলতি অর্থবছরে (২০১৬-১৭) সংশোধিত বাজেট তিন লাখ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি এ ৮ মাসে বাজেটের টাকা ব্যয় হয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) খাতে ৫৩ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা মার্চ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে।

সঠিক সময়ে বাজেটের অর্থ ব্যয় না হওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও। সম্প্রতি বিভিন্ন সংস্থা ও অর্থনীতিবিদরে সঙ্গে প্রাক-বাজেট বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেছেন, বছর শেষে মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর টাকা খরচ বেড়ে যায়। এতে চুরিচামারি বেশি হয়। এটা বন্ধ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, জেলা পরিষদের টাকা ব্যয় নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। আগামীতে এসব বন্ধে মনিটরিং করা হবে।

এদিকে টাকা খরচ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারের উন্নয়ন ব্যয় শ্লথ গতি বিরাজমান রয়েছে। এ গতি কাটাতে এডিপি বাস্তবায়ন হার বৃদ্ধির জন্য নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বিশেষ করে ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন হলে উন্নয়ন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে অর্থ বিভাগ থেকে।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন- প্রথম কথা হচ্ছে, সংশোধিত বাজেটের পুরো অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হবে না। ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোনো বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি বলেন, বাজেটের টাকা খরচের অনুপাত ২০১২ সালে ছিল ৯৩ শতাংশ। ২০১৬ অর্থবছরে কমে ৭৮ শতাংশে এসেছে। এ অর্থনীতিবিদের ধারণা, চলতি বাজেটের টাকা ব্যয় সর্বোচ্চ ৭০ থেকে ৭২ শতাংশ হবে, এর বেশি নয়। ফলে এতে বাজেট বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।

সূত্রমতে, সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে সম্পদ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাজেট বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়টিও আলোচনা হয়েছে। ফলে বাজেট কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ওই বৈঠকে।

তবে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম যুগান্তরকে বলেন, বাজেট সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন যে হবে না, সেটি বলা যাচ্ছে না। কারণ রাজস্ব খাতে যে বরাদ্দ অর্থাৎ বেতন-ভাতা, পেনশন ইত্যাদিতে অর্থ খরচ হবেই। কেননা বেতন-ভাতা এগুলো না দিয়ে তো উপায় নেই। অন্যদিকে উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে এডিপির বাস্তবায়নও আশা করছি ৯০ শতাংশের বেশি হবে।

কেননা এখন পুরোদমে কাজ চলছে। জুনে এসে ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করা হলে তখন বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, উন্নয়ন হলে একটু ভোগান্তি তো জনগণকে মানতেই হবে। তবে মূল বিষয়টি হল যেসব উন্নয়ন কাজ হয়, সেগুলোর গুণগতমান যদি ঠিক থাকত তাহলে ৭-৮ বছর আর খোঁড়াখুঁড়ি করার প্রয়োজন হতো না। তখন জনদুর্ভোগও কম হতো।

কিন্তু যেসব কাজ করা হচ্ছে সেগুলো ২-৩ বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে ঘন ঘন কাজ করতে গিয়ে জনদুর্ভোগ বাড়ছে। এজন্য যত দ্রুত সম্ভব উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সমাপ্ত করে কাজের জায়গাগুলো সংস্কার করা প্রয়োজন।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের মোট বাজেট হচ্ছে তিন লাখ ৪০ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। সম্প্রতি তা কাটছাঁটের মাধ্যমে সংশোধিত বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয় তিন লাখ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ইতিমধ্যে বাজেট থেকে ২৩ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়। শেষ পর্যন্ত এ সংশোধিত বাজেট বাস্তবায়ন নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ হিসাব মতে, জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি এ ৭ মাসে বাজেটের মাত্র ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ টাকা খরচ হয়েছে। বাকি ৪ মাসে ব্যয় করতে হবে ৬১ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থ। গত বছর একই সময়ে টাকা খরচের হার বাজেটের ৩৬ দশমিক ২ শতাংশ ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, অন্যান্য দেশের বাজেট একটু সম্প্রসারণমূলক হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এটি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক বছর একটা বিশাল বাজেট দেয়া হচ্ছে, এতে একটা প্রত্যাশা সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া কতগুলো রূপকল্পের লক্ষ্য স্থির করা হয়, যা বাজেটকালীন সময়ে বাস্তবায়ন একেবারেই সম্ভব হচ্ছে না।

এটি জেনেশুনেও বড় বাজেট দেয়া হয়। ফলে বাস্তবায়নে একটা চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়। অপরদিকে রাজস্ব আহরণের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। তিনি আরও বলেন, বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হলেও সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার মতো এখন কেউ নেই। ফলে সরকারও পার পেয়ে যাচ্ছে।

নতুন বাজেট আরও বড় হচ্ছে বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এখন নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে তাই বড় বড় প্রকল্প নিচ্ছে সরকার। মূল লক্ষ্য বেশিরভাগ রাজনৈতিক কৌশল।

বাজেট উন্নয়নের যে হাতিয়ার আমার মনে হয় এটা নিয়ে সরকার অতটা সজাগ নয়। শেষ সময়ে বাজেট বাস্তবায়নে তড়িঘড়ি করে টাকা ব্যয় করা হয়। যার বেশিরভাগ অপচয় হয়। এখন এমন পরিস্থিতি, টাকাগুলো খরচ করলে এক শ্রেণীর লোকের জন্য বেশি সুবিধা হয়।

মানুষের কল্যাণ হবে কিনা, তা ভাবা হচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটের লক্ষ্য ধরা হয়েছে চার লাখ কোটি টাকার উপরে। এর মধ্যে এডিপি হচ্ছে এক লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা।

অনুন্নয়ন ব্যয় : চলতি বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয় দুই লাখ ১৫ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। এ ব্যয় থেকে সরকারি কর্মকর্র্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ভর্তুকি, প্রণোদনা, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন ও গ্র্যাচুইটি, সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধ করা হয়। এ অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে অর্থাৎ জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ ব্যয় হয়েছে এক লাখ এক হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। এটি মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের ৪৪ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থবছর শেষ হতে সময় আছে ৪ মাস। জুনের মধ্যে বাকি এক লাখ ১৪ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। অর্থাৎ ৫৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ অর্থ এ সময়ের মধ্যে ব্যয় করতে হবে সরকারকে।

এডিপি : বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন ধীরগতির কারণে বাজেট বাস্তবায়ন পুরোপুরি না হওয়ার আশঙ্কার অন্যতম একটি কারণ।

শুরুতে এ বছর এডিপির আকার নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৫৩ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। এটি মোট এডিপির ৪৫ শতাংশ। বাকি ৪ মাসে ব্যয় করতে হবে ৫৬ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা।

জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা দেয়া হয়েছিল দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। কাটছাঁট করে পরে সংশোধিত বাজেট করা হয় দুই লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে প্রকৃত অর্থ ব্যয় হয় দুই লাখ ২৫ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ৭৮ শতাংশ।

একই ভাবে দেখা গেছে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাজেট ঘোষণা দেয়া হয় দুই লাখ ৫০ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেট করা হয় দুই লাখ ৩৯ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকৃত বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে দুই লাখ দুই হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ৮৩ শতাংশ।