পোশাক শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় বারবার চাপ সৃষ্টির পর এবার জাতিসংঘে যাচ্ছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান রপ্তানিবাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। বাংলাদেশসহ পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলো কত দিনের মধ্যে স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন ও সিবিএ করার অধিকার নিশ্চিত করাসহ এ খাতের শ্রমিকদের মানবাধিকার রক্ষা করবে সে বিষয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে চুক্তি চায় তারা। ‘ইইউ ফ্ল্যাগশিপ ইনিশিয়েটিভ অন দ্য গার্মেন্ট সেক্টর’ শিরোনামের ওই প্রস্তাবে এরই মধ্যে সম্মতি দিয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যবিষয়ক কমিটি এবং কর্মসংস্থান ও সামাজিক ইস্যু বিষয়ক কমিটি। জাতিসংঘে যাওয়ার আগে ওই প্রস্তাবের ওপর আগামী ২৭ এপ্রিল ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ভোটাভুটি হওয়ার কথা রয়েছে। তার আগে ২৬ এপ্রিল পার্লামেন্টে প্রস্তাবটির ওপর বিতর্ক হবে।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, যেসব দেশ টেকসই পরিবেশে বস্ত্র ও পোশাক তৈরি করছে বলে প্রমাণিত হবে, তাদেরই শুধু কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হবে। ইইউ খুব শিগগির তাদের জিএসপি কর্মসূচি পুনর্মূল্যায়ন করবে। তখনই এ পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে মত দিয়েছে ইইউয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিটি। ওই সময়ের আগেই বাংলাদেশ শ্রম পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে ব্যর্থ হলে ইইউয়ে জিএসপি স্থগিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ইইউয়ের ওই উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্রাসেলসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন। গত ২১ মার্চ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জরুরি বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশসহ ইউরোপে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্যই এ উদ্যোগ নিয়েছে ইইউ। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে যে ইইউয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার স্বাধীনতা দেওয়া এবং শ্রমিক অধিকার ও শ্রমিকদের মানবাধিকার কঠোরভাবে বাস্তবায়নের জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি আমাকে দেওয়া এক চিঠিতে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বলেছে, খুবই দ্রুত বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় উন্নতি করতে না পারলে ইইউয়ে পাওয়া বাংলাদেশের জিএসপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ’

এর আগে ১০ মার্চ ব্রাসেলসে নিযুক্ত বাংলাদেশের কাউন্সিলর (কমার্স) মোহাম্মদ জহিরুল কাইয়ুম জরুরি বার্তায় বলেন, ইইউ বারবার একটি বার্তাই দিচ্ছে—তা হলো, বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকার রক্ষা এবং শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার বাংলাদেশ কবে নাগাদ কিভাবে বাস্তবায়ন করবে সে সম্পর্কে একটি রোডম্যাপ বা পরিকল্পনা আগামী মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্টের বৈঠকে এবং জুনে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সম্মেলনে তা জানাতে হবে। অন্যথায় ইইউয়ে বাংলাদেশের অস্ত্র বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা (ইবিএ) হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে, বাংলাদেশকে দেওয়া জিএসপি স্থগিত করা হবে।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টে প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছে পার্লামেন্টের উন্নয়নবিষয়ক কমিটি। ওই কমিটির পাঁচ সদস্য গত ২৩ মার্চ ঢাকা সফর শেষে যাওয়ার সময় সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বাংলাদেশকে আগামী ১৮ মের মধ্যেই শ্রম পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। ১৮ মে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, আইএলওসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্ট-এর বৈঠক হবে ঢাকায়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা ইইউয়ের ওই উদ্যোগ সম্পর্কে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। কারণ ইইউ বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান বাজার। ফলে তারা এই খাত বিষয়ে নতুন কোনো উদ্যোগ নিলেই তা বাংলাদেশের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক খাতের উন্নয়নে সরকার অনেক উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু ইইউ বা যুক্তরাষ্ট্র এটি বুঝতে চায় না যে শূন্য থেকে একবারেই শতভাগ মান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সে জন্য বাংলাদেশের অনেক সময়ের দরকার। ’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও ইভান্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, ‘ইইউয়ের এই উদ্যোগ সম্পর্কে আমার স্পষ্ট জানা নেই। না জেনে বিষয়টি সম্পর্কে মন্তব্য করা উচিত হবে না। ’

‘ইইউ ফ্ল্যাগশিপ ইনিশিয়েটিভ অন দ্য গার্মেন্ট সেক্টর’ শীর্ষক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিশ্বে তৈরি                                                                                                                             পোশাকের বাজার ২ দশমিক ৮৬ ট্রিলিয়ন ইউরো। এর বড় অংশের ক্রেতাই ইইউ। এ খাতে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে সাত কোটি, যার তিন-চতুর্থাংশই নারী। এসব শ্রমিক দীর্ঘ কর্মঘণ্টার দুর্ভোগে রয়েছে; নিম্ন মজুরি, অনিশ্চয়তা ও নির্যাতনের মধ্যে আছে।

পোশাক শ্রমিকরা নিয়মিত যেসব সমস্যার মুখে পড়ে সেগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ওই প্রস্তাবে। এতে বলা হয়েছে, ‘কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা, উপযুক্ত মজুরি কাঠামো, ট্রেড ইউনিয়ন করার স্বাধীনতা, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ করাটাকেই অনেকে টেকসই উত্পাদন ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করে। তবে এর বাইরেও আরো অনেক কিছু করার আছে বলে ইউরোপীয় কমিশন (ইসি) মনে করে, যা শ্রমিকদের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই ইইউকে পোশাক রপ্তানিকারকদের বাধ্যতামূলকভাবে মানবাধিকার এবং সামাজিক ও পরিবেশগত বিষয়ে সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য পোশাক খাতের সুতা উত্পাদক থেকে চূড়ান্ত ক্রেতা পর্যন্ত ফেয়ার ট্রেড স্কিম বাস্তবায়ন, কোড অব কন্ডাক্ট জোরদার করাসহ জাতিসংঘের বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস নীতি বাস্তবায়ন এবং অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হবে। তাই ব্যবসা ও মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের বাধ্যতামূলক চুক্তি খুবই জরুরি, যা পোশাক খাতের কম্পানিগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা বাড়াবে। আর এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে ইইউভুক্ত দেশগুলো সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত থাকবে। আমরা আশা করি, এটা খুব শিগগির চূড়ান্ত হবে। ’

উন্নয়ন কমিটির খসড়ায় সম্মতি জানিয়ে ইইউ পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ক কমিটি বলেছে, বাংলাদেশের পোশাক খাতে শ্রম অধিকার ও কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে কমপ্যাক্ট কাজ করলেও পুরোপুরি কমপ্ল্যায়েন্স নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে যেসব বিষয়ে ঘাটতি চিহ্নিত হয়েছে, তা দূর করতে ইউরোপীয় কমিশনের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ভবিষ্যতে জিএসপি মূল্যায়নের সময় যেসব দেশ টেকসই পরিবেশে বস্ত্র ও পোশাক উত্পাদন করবে, শুধু তাদেরই জিএসপি দেওয়া হবে। এ জন্য সাসটেইনেবিলিটির ধরন নির্ধারণ করে সার্টিফিকেশন সিস্টেম চালু করে সার্টিফিকেট দেওয়ার উদ্যোগ নেবে তারা। রপ্তানিকারক দেশগুলোর সরকারগুলোকেও এসব কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হবে, যাতে জাতিসংঘের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ করে তারা।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কর্মসংস্থান ও সামাজিক ইস্যু বিষয়ক কমিটি ওই উদ্যোগের সমর্থনে বলেছে, যেসব দেশ ইইউয়ে জিএসপি পাচ্ছে, তাদের এই সুবিধার সঙ্গে একটি শর্ত জুড়ে দেওয়া যায়। শর্তটি হলো জিএসপি পেতে জলে শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো এবং আইএলওর শর্ত মেনে চলতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইইউ দেশগুলোকে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দেবে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোকে (ইপিজেড) ওই দেশের শ্রম আইন মেনে চলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া আছে। সেখানে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়া হয় না। এ ধরনের সংকট দূর করে আইএলওর কনভেনশন বাস্তবায়ন করতে হবে।