বিভক্তি ক্রমাগত বাড়ছে ফ্রান্সে। ফের ঘটেছে সন্ত্রাসী হামলার থাবা। প্যারিসের স্যঁজ এলিজিতে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের দায় স্বীকার করা হামলায় নিহত হয়েছে এক পুলিশ। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র দুদিন আগে এই হামলা পাল্টে দিতে পারে ভোটের হিসাব নিকাশ। বিশ্লেষকরা এমনটাই মনে করছেন। এবারের নির্বাচনী প্রচারণা ইতিমধ্যে নানা বিতর্ক ও নাটকীয়তার জন্ম দিয়েছে। ভোটাররা নানা মতে বিভক্ত। রেকর্ড সংখ্যক ভোটার এখনো সিদ্ধান্তহীনতায়। এমতাবস্থায় বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশের ওপর গোলাগুলির ঘটনা কট্টর ডানপন্থি ভাবধারার পালে জোয়ার এনে দিতে পারে। ওই হামলা চালানো সন্দেহভাজন উগ্রপন্থি কর্মকাণ্ডের জন্য ফরাসি নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে পূর্বপরিচিত বলে জানা যাচ্ছে। সিএনএন-এর মেলিসা বেল বলেন, ‘এ ঘটনা প্রচারণার শেষ সময়টা নতুন করে সাজিয়ে দিয়েছে। এখন গুরুত্বের কেন্দ্রবিন্দু হলো আইনশৃঙ্খলা, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, অভিবাসন ও জাতীয় পরিচয়। লড়াইটা এখন অনেকটাই হতে যেতে পারে ম্যারিন ল্য পেন বনাম তার বিরোধীরা।’
কট্টর ডানপন্থি প্রার্থী ম্যারিন ল্য পেনের ফ্রন্ট ন্যাশনাল পার্টি তার প্রচারণার কেন্দ্রে রেখেছে অভিবাসন ও ইসলামের ধারণাপ্রসূত হুমকিকে। হামলার খবর যখন এলো, ল্য পেন তখন অপর ১০ প্রার্থীর সঙ্গে টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার হওয়া বিতর্কে অংশ নিচ্ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জবাব দেন, দেশের নিরাপত্তা জনগণের স্বার্থরক্ষা করতে পারছে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে সবকিছু করা হচ্ছে না। আমাদের প্রয়োজন ‘ইসলামিস্ট টেররিজম’-এর বিরুদ্ধে সফল লড়াই নিশ্চিত করার রসদ। আমি চাই না আমাদের তরুণ সমাজ এই বিপদের সঙ্গে বসবাস করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠুক। হেলায় দিন কাটানোর সময় শেষ।’
রোববার নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডের ভোট শুরুর আগে প্রচারণা চালানোর জন্য প্রার্থীদের হাতে সময় আছে মাত্র একদিন। তিন প্রার্থী- ল্য পেন, মধ্যডানপন্থি ফ্রাঁসোয়া ফিলন ও মধ্যপন্থি স্বতন্ত্র প্রার্থী ইম্যানুয়েল ম্যাক্রন তাদের প্রচারণা স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছেন। ফিলন বলেন, তিনি পুলিশের সঙ্গে ‘সংহতি’ দেখাতে চেয়েছেন। প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবারের হামলার টার্গেট পুলিশ ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। এক পুলিশ সদস্য গুলিতে নিহত হন। আহত হন অপর দুজন। ম্যাক্রনও একই রকম বার্তা দিয়ে প্রচারণার ইতি টানেন। এক বিবৃতিতে তিনি দুটি সমাবেশ বাতিল করার কথা জানান। সমাবেশের কারণে নিরাপত্তা সদস্যরা ব্যস্ত থাকুক সেটা তিনি চাননি। তিনি বলেন, ‘আমাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য’ নিরাপত্তা সদস্যদের একত্র করার প্রয়োজন হবে।
প্রার্থীরা যখন তাদের প্রচারণা স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছেন, তখন ওই হামলার সঙ্গে যোগসূত্র আছে এমন এক সন্দেহভাজন বেলজিয়াম পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে, যাকে ফরাসি পুলিশ খুঁজছিল। ফরাসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র পিয়েরে হেন্ড্রি ব্র্যান্ডেট সিএনএনকে এ তথ্য দিয়েছেন। ওদিকে বৃহস্পতিবারের হামলাকারী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। হামলাকারীর পরিবারের তিন সদস্যকে আটক করা হয়েছে বলে জানান প্যারিস প্রসিকিউটরের মুখপাত্র।
সন্দেহভাজন ব্যক্তি যে একজন ফরাসি নাগরিক এবং নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারিতে ছিল এমন বর্ণনা সরকার সমালোচক রাজনীতিকদের কাছে হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। নাগরিকদের সুরক্ষায় সরকারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সমালোচনা করে আসছেন এসব রাজনীতিক।
তদন্তের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এক সূত্র সিএনএনকে বলেছেন, সন্দেহভাজন এই ব্যক্তি ‘ফিশে এস’ বা ‘এস কার্ড’-এ ছিল। অর্থাৎ জাতীয় নিরাপত্তার জন্য তাকে সম্ভাব্য হুমকি বলে বিবেচনা করা হয়।
২০১৬ সালে কর্তৃপক্ষ ১৫ হাজার ব্যক্তির ওপর নজরদারি শুরু করে, যারা উগ্রপন্থায় ঝুঁকে পড়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এর আগে ফরাসি কর্মকর্তারা বলেছিলেন তাদের ‘এস কার্ড’ তালিকায় ১০ হাজার ব্যক্তি ছিল। সিএনএন-এর প্যারিস ব্যুরোপ্রধান জিম বিটারম্যান বলেন, ‘সে যদি আসলেই এস কার্ডে থেকে থাকে, তাহলে জনসাধারণ এবং কিছু রাজনীতিকদের কাছ থেকে প্রশ্ন আসবে। তারা জানতে চাইবেন, সে যদি নজরদারিতেই থেকে থাকে আর পুলিশ যদি তাকে আগে থেকে জেনে থাকে তাহলে সে কিভাবে আধাস্বয়ংক্রিয় একটি অস্ত্র নিয়ে এদিন এমন একটি হামলা চালাতে সক্ষম হলো?’
সিএনএন-এর প্যারিস প্রতিনিধি মেলিসা বেল বলেন, সন্দেহভাজনের এস কার্ডে থাকার বিষয়টি ল্য পেনের বাগাড়ম্বরকে জোরালো করবে। ল্য পেন এর আগে বলেছেন, ‘ঘৃণার প্রচারণা করা বিদেশি ইমাম আর বিদেশি এস কার্ড নামধারীদের মৌলবাদ বহিষ্কার করা প্রয়োজন আমাদের।’ বেল বলেন, ‘এটা নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে কিনা তা দেখার বিষয়।’
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ গ্লেন শোয়েন সিএনএনকে বলেন, বৃহস্পতিবারের হামলা ফরাসি ভোটকে ছাপিয়ে আরো বড় প্রভাব রাখতে পারে। তিনি বলেন, ‘৮ই জুন বৃটেনে নির্বাচন আসছে। সেপ্টেম্বরে জার্মানির। এর আগের কিছু ঘটনার তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট এ ঘটনা বেশ বড় প্রভাব রাখবে।’
ফরাসি নির্বাচনের আবহ কলঙ্কিত করা সন্ত্রাস-সম্পর্কিত ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৫ সালের প্যারিস হামলা থেকে শুরু করে গত বছর বাস্তিল দিবসে নিস শহরের হামলার ঘটনা এখনো অনেক ভোটারের মানসপটে জাজ্বল্যমান।
ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাথিয়াস ফেকল জানিয়েছেন, মার্সেই শহরে ‘সহিংস হামলা’র প্রস্তুতি নেয়া দুই সন্দেহভাজনকে এ সপ্তাহে গ্রেপ্তারের পর নির্বাচনের দুই রাউন্ডের জন্য আনুমানিক ৫০ হাজার পুলিশ সদস্য ও সেনাকে নিয়োগ করা হবে।
সিএনএন-এর সাইরিল ভ্যানিয়ের বলেন, আরেকটি হামলার আশঙ্কায় অনেক ভোটার ভোট দিতে যেতে নিরুৎসাহিত বোধ করবেন কিনা সেটা দেখার বিষয়। প্রচারণায় এতো বেশি মেরুকরণ ছিল আর এ নির্বাচন নানা দিক থেকে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে, হয়তো ভোটাররা তাদের বার্তা দিতে চাইবেন। কিন্তু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার যদি বাড়ি থেকে বের না হন তাহলে তা ল্য পেনের উপকারে আসবে। ভ্যানিয়ের বলেন, ‘ভোটার উপস্থিতি কম হলে যে ল্য পেন উপকৃত হবেন সে বিষয়ে একমত অনেকেই। তার ভোটাররা অনেক বেশি অনুপ্রাণিত। এদের বেশিরভাগই তাদের পছন্দ নিয়ে নিশ্চিত।’
নিরাপত্তার নিশ্চয়তা শতভাগ বলা যাচ্ছে না। কারণ, ফ্রান্সজুড়ে সকল ভোটকেন্দ্রে সফলভাবে পুলিশি নিরাপত্তা বণ্টন অত্যন্ত কঠিন কাজই বটে। সিএনএন-এর বিটারম্যান বলেন, ‘রাস্তায় ৫০ হাজার পুলিশ থাকলেও ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৬০ হাজার। আপনি পূর্ণাঙ্গ সুরক্ষা দিতে পারবেন না।’
উল্লেখ্য, পরবর্তী প্রেসিডেন্টকে বেছে নিতে ফরাসিরা নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে ভোট দেবেন রোববার। প্রথম রাউন্ডের সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত শীর্ষ দুই প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় রাউন্ডের ভোট হওয়ার কথা ৭ই মে।