ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর শেষ হয়েছে সাত দিন আগে। কিন্তু এ সফর নিয়ে আলোচনা শেষ হচ্ছে না। সমালোচনাও শুরু হয়েছে কিছু কিছু। মনে হয় এসব চলবে আরও অনেক দিন। তার আসার আগে আলোচনা ছিল, মোদি কি বাংলাদেশকে কিছু দিতে আসছেন না কি বাংলাদেশ থেকে নিতে আসছেন? তার এ সফরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কি আগের মতো নাতিশীতোষ্ণ থাকবে না কি উষ্ণতা ছড়াবে? পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটা দৃঢ় হবে কি? তার চলে যাওয়ার পর আলোচনা শুরু হয়েছে, তিনি আমাদের কী দিলেন আর ভারতের জন্য কী নিয়ে গেলেন? দিন যত যাচ্ছে, মনে হচ্ছে ‘মোদি-ঘোর’ বুঝি কেটে যাচ্ছে। তার এ সফরকে উভয় দেশের স্বার্থে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলতে হবে। মাত্র ৩৫ ঘণ্টার সফরকালে উভয় দেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। ৬৫ দফা যৌথ ঘোষণাও এসেছে। বলা বাহুল্য, দুই দেশের কাছেই পারস্পরিক স্বার্থ আছে পরস্পরের। ভারতের মোটা দাগের স্বার্থ- ১. ট্রানজিট-কানেকটিভিটি ২. ইনসারজেন্সি রোধে সহযোগিতা ৩. পুঁজি বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধি ৪. বাণিজ্য সম্প্রসারণ ৫. চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দর ব্যবহারের সুযোগ এবং জঙ্গি দমনে সহযোগিতা। বাংলাদেশের স্বার্থ মোটা দাগে- ১. পানি সমস্যা ২. সীমান্ত হত্যা ৩. সন্ত্রাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও মৌলবাদীদের আশ্রয় ও ভূমি-সহযোগিতা বন্ধ ৪. বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ও বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমানো ৫. বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহারে ক্ষতিপূরণ ও ন্যায্য শুল্ক প্রাপ্তির নিশ্চয়তা এবং মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ দমনে কার্যকর পারস্পরিক সহযোগিতার প্রতি আন্তরিকতা। উল্লিখিত বিষয়াবলি ছাড়াও আরও অনেক স্বার্থ আছে দুই দেশেরই।
নরেন্দ্র মোদির এই সফরের তাৎক্ষণিক ফলাফল আশা করা ঠিক নয়। তবে ভারতের কোনো রাষ্ট্রনেতার বাংলাদেশ সফর এমন সর্বদলীয় বরণমালায় ইতিপূর্বে কখনো ধন্য হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করার জন্য বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে আগ্রহের কমতি ছিল না বললেই চলে, বলা চলে উভয় দলের মধ্যে একটা দৃষ্টকটু, রুচিহীন প্রতিযোগিতাই যেন হয়েছে। আওয়ামী লীগের লোকজন ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ঐতিহাসিক বলে বর্ণনা করে অসীম তৃপ্তিবোধ করেন। তবে অনেক বাংলাদেশি যেমন জানেন যে, এ সম্পর্কটা গড়ে উঠেছে সেই দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসের মাধ্যমে, তা বিজেপি নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও না জানার কথা নয়। ভারতের সরকারি-বেসরকারি নেতা-নেত্রীর ব্যাপারে আওয়ামী লীগের স্বাভাবিক আগ্রহের চেয়ে নরেন্দ্র মোদির ব্যাপারে আগ্রহী এবার দুই কারণে অনেকটা বেশি বলে মনে হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বিতর্কিত, আদর্শবর্জিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত লীগ সরকারের স্বীকৃতি। বিশ্বের প্রায় সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং কমনওয়েলথ, ইইউ, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী মহল কর্তৃক প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনটির ব্যাপারে মোদি সরকারের এমন একটা স্বীকৃতি লীগ সরকারের জন্য তাদের নীতিনির্ধারকরা জরুরি মনে করাটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ বাংলাদেশের মানুষ জানেন যে, ওই নির্বাচনটি তারা একতরফাভাবে করতে পেরেছিলেন ভারতের তৎকালীন ক্ষমতাসীন কংগ্রেসি সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে। নির্বাচনের আগে সে দেশের কংগ্রেসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশীদ এবং পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের বাংলাদেশে আগমন ও তৎপরতা সম্পর্কে দেশ-বিদেশের সচেতন মহলের জানা আছে। উল্লেখ্য, মোদি সরকার সুজাতা সিংকে পদচ্যুত করেছে। লীগ সরকারের মধ্যে দুর্ভাবনা থাকা অস্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও একটা ধারণা আছে যে, কংগ্রেস বা কংগ্রেসি সরকারের কাছ থেকে আওয়ামী লীগ বা সরকার যে সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার কথা বিজেপি বা বিজেপি সরকারের কাছ থেকে তা নিশ্চয়ই পাবে না। এতে লীগ সরকার একটা দুর্বলতায় ভোগার কথা। নরেন্দ্র মোদির সফরকে পুঁজি করে তারা জনগণকে এ ধারণা দিতে চেয়েছে যে, ভারতে দল বড় কথা নয়, সরকার বলে কথা। ভারতে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, তারা আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, কংগ্রেসের সঙ্গে অনেকটা ‘সাপে-নেউলে’ সম্পর্কের বিজেপির প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ করে দল হিসেবে বিজেপির সঙ্গেও সখ্য গড়ে তোলা। মনে হয় ভারত রাষ্ট্রের চেয়ে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারই গুরুত্ব পেয়েছে বেশি।
বিস্ময়কর ছিল বিএনপির ভূমিকা। দলটির পক্ষ থেকে এখন যাই বলা হোক না কেন, তাদের ভারত-বৈরী মনোভাব কারোই অজানা থাকার কথা নয়। জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সময় বাদ দিয়ে ভারতের কোনো রাষ্ট্র নেতা-নেত্রীর ব্যাপারে বিএনপি কখনো এমন আগ্রহ দেখায়নি। বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের কোনো পদক্ষেপকেই সাধুবাদ জানায়নি দলটি। বাংলাদেশ-ভারত নানা সমস্যা নিয়ে, ‘ফেলানীদের’ লাশ নিয়ে কথাবার্তা এ দেশের দলবহির্ভূত বা বাম প্রগতিশীল দলসমূহও বলেছে। ওইসব বক্তব্য আর ভারত-বৈরিতা কিন্তু এক নয়। অন্যদের সঙ্গে বিএনপির পার্থক্যটা ছিল এক জায়গায় যে, অন্যদের বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ইস্যুভিত্তিক বক্তব্যে ভারতের প্রসঙ্গ এসেছে, আসে; আর বিএনপি ভারত-বৈরী অবস্থান থেকেই কোনো একটা ইস্যুকে অ্যাড্রেস করে। অথচ আমরা অনেকে বহু আগে থেকেই বলার চেষ্টা করেছি যে, বিএনপির ভারতনীতি ভুল। ভারত-বৈরী নীতি নিয়ে বাংলাদেশে ‘নীতিবাগিশ’ বাগাড়ম্বরের রাজনীতি করা যাবে, দেশ ও জনগণের কল্যাণের জন্য যে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া দরকার সেই ক্ষমতায় রাজনীতিকরা যাবে না। পৃথিবীর কোথাও বৃহৎ নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরী আচরণ করে কোনো রাষ্ট্র ও জাতির কল্যাণ হয়নি। ভারত বাংলাদেশের অতি নিকট ও বৃহৎ প্রতিবেশী। ভারতের আয়তনই শুধু বড় নয়, বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ভারত, বিশ্বের উঠতি পরাশক্তি তারা এবং বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারত। এমন প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক, সদ্ভাব, আয়তন ও অর্থনীতির দিকসহ নানা সক্ষমতার প্রশ্নে পিছিয়ে থাকা দেশের উন্নতি, অগ্রগতি, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য খুবই জরুরি। বন্ধু পাল্টানো যায়, কিন্তু প্রতিবেশী পাল্টানো যায় না। প্রতিবেশী ছোট হোক কিংবা বড় হোক, খারাপ সম্পর্ক রেখে ভালো থাকা যায় না। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব আর ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বকে একই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা ঠিক হবে না।