বারে বারে বারানসী

0
2081

download (6)

সকালের নতুন সূর্যের প্রথম কিরণ ঘাটের বিস্তৃত সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়ার আকুতি নিয়ে থমকে আছে। তার আগে সে হয়ত নতুন করে দেখে নিতে চাইছে বিশ্বের প্রাচীনতম জনপদের জেগে ওঠাকে। আরতির আগুনের লেলিহান শিখার প্রজ্জ্বল বর্ণ এখন ভোরের সূর্যের রং এর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। শুরু হয়েছে গঙ্গা স্ত্রোত্য। পুবালী আকাশে ভোরের আরতির সুর-ধ্বনি ‘গঙ্গা-মাইয়া’র আরাধনায় জাগছে শহর। প্রতিটি ঘাটে চলছে গঙ্গাস্নানের ব্যস্ততা। উঁচু চরুতরায় পালোয়ানী কসরত। টিকিতে ফুল বাঁধা পুরোহিতের ব্যস্ততা। দলে দলে নারী পুরুষের অবগাহন। পাপ বিসর্জনের আকুতি, ষাঁড়-সন্ন্যাসীর সহবস্থান। গঙ্গার পশ্চিম তীরে বরুন আর অসি নদীর সঙ্গমে গড়ে ওঠা জনপদে ধীরে ধীরে জাগছে অখন্ড ভারতবর্ষ। আর ভারতবর্ষের পিছনে দাঁড়িয়ে সমগ্র বিশ্ব। তারা ভেসে বেড়াচ্ছে নৌকা বিহারে। যন্ত্রবন্দি করছে আমাদের প্রাচীন কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতির খন্ডচিত্রকে। এঘাটে-সেঘাটে, হেলে পড়া বিশাল ছাতার ফাঁক দিয়ে টুক করে সূর্য উঠে রঙ্গীন করলো দশাশ্বমেধ, মণিকর্ণিকা, সহল্যাবাই, পঞ্চগঙ্গা, কেদার, তুলসী, অসি, হরিশচন্দ্র, মুন্সিঘাটকে। কানে ভেসে আসছে ধর্মকথার খন্ডস্বর, ভজনের পাতলা সুর, বিদেশী ভাষার কথপোকথন, স্থানীয় ভাষার উচ্চস্বর। আর তার মধ্যে জেগে উঠছে মন্দিরের শহর, সাধুর শহর, পূণ্যের শহর-পাপের শহর, ধনীর শহর-দরিদ্রের শহর, গলির শহর-রাজপথের শহর, দেবতার শহর-অসুরের শহর, স্মৃতির শহর-ইতিহাসের শহর, অতীতের শহর-বর্তমানের শহর, ভারতের শহর-বিশ্বের শহর- সকলের শহর বারানসী।
অতীতের কাশী। বাঙালীর সেকেন্ড হোম। এখনকার বারানসী। শুধু বাঙালী কেন, সমস্ত হিন্দুরাই পূন্যার্জনের পটচিত্র আঁকতে বসলে বারানসীর তুলিতে আগে হাত দেবেন। অলিতে গলিতে মন্দিরের চাঁদমালা। সর্বাগ্রে বিশ্বনাথ মন্দির। একান্ন পীঠের অন্যতম বারানসী। এখানে দেবীর কুন্ডল পড়ে মনিকর্ণিকা ঘাটে। গোধুলিয়া মোড় থেকে এগিয়ে বাঁ-হাতে এগোলেই চোখে পড়ে পানমশলা, জর্দা, খেলনা, বাসনকোসন, পূজা উপাচার, লস্যি-পেঁড়ার দোকান। দোকান আর হরেক পূণ্যার্থীর মুখাবয়ব দেখতে দেখতে হঠাৎই পৌঁছানো যায় আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে বিশ্বনাথ মন্দিরের দোরগোড়ায়। ইতিহাসের মন্দির বারবার মুসলিম হানায় বিনষ্ট হওয়া মন্দির এখন সংস্কারের আলোয়ান গায়ে চাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে। বারানসীর দ্বিতীয় আকর্ষণ, অন্তত: আমার কাছে, এখানকার আহার্য। আমার পূণ্যের একাগ্রতা বারবার প্রতিহত হয়েছে রাস্তার দু’ধারে হাতছানি দিয়ে ডাকা গরমপুরি, কচুরি, সব্জি, মেঠাই, পেঁড়া, মালাই লস্যি, টিকিয়া, দহি চাটের চটুল হাতছানিতে। লস্যির লাস্য আমাকে টানা আধঘন্টা হাটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল দ্বারকাপুরীতে। হালকা হলুদ বর্ণের ঘন লস্যি আর মেরুন কেশরের যুগল বন্দিতে ঠোট যখন তাল মেলালো তখন শরীর আর মন দুই-ই ধন্য। আর হ্যাঁ, রয়েছে বারানসীর পান, যা না খেলে বারানসী আসা আপনার বৃথা।
দু’দিন সময় নিয়ে বারানসী আসা যে আমার পাপের বোঝা আরও ভারী করলো তা বুঝতে পেরেছিলাম এখানে পা দিয়েই। আসলে ঠিক কতদিন সময় নিয়ে এখানে এলে বারানসীটা ভালো করে দেখা যায় তা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। মন খচখচ করছিল। যেন অনেক কিছু দেখা হল না। সমগ্র ভারতবর্ষকে একটা ছাতার তলায় দেখতে গেলে দু’দিনের সময় যে যথেষ্ট নয় তা প্রতিপদে আঁচ করলাম। মন বলছিল গঙ্গাস্নানে নয়- এই পাপস্খলন করতে গেলে বারানসীতে আসতে হবে আবার, হয়ত বারবার।