দেশের মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রমে সম্পর্কে গুরুতর অভিযোগ এনেছেন ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গর্ভনর বলেছেন, দেশের মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ে তামাশা চলছে। এই ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে অতিরিক্ত চার্জ নেয়া হচ্ছে। এই বিষয়টি জরুরি ভিত্তি ভেবে দেখা প্রয়োজন।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর অফিসার্স ক্লাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আয়োজিত উপ-কর কমিশনার সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ১০০ টাকা পাঠাতে লাগে এক টাকা ৮৬ পয়সা। মতলবটা কত বদ আপনি চিন্তা করেন। এক টাকা ৮৬ পয়সা মানেই দুই টাকা। দুই টাকা দিয়ে যিনি পাঠাবেন তারতো একাউন্ট নাই।
তিনি প্রশ্ন করেন, ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাতে যদি ১০০ টাকায় মাত্র ৪০ পয়সা লাগে, তাহলে মোবাইল ট্রান্সফারে কেন এক টাকা ৮৬ পয়সা বা দুই টাকা লাগবে?
তিনি বলেন, কিন্তু বিদেশিরা ধন্য ধন্য দিচ্ছে আমাদের মোবাইল ব্যাংকিং চলছে। এগুলো খুব ভালো করে চিন্তা-ভাবনা করে সরকারকে বুঝতে হবে। ওই জায়গায় হাত দিতে হবে। এটা দেখা দরকার, রেগুলেশন (নিয়ন্ত্রণ) হওয়া দরকার।
গ্রাহককের ব্যাংক হিসাবের গোপণীয়তা রক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, প্রয়োজন না হলে কোনো গ্রাহকের ব্যাংক হিসাব দেখা উচিত নয়। কেবল সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে দেখা যেতে পারে। এটা মানুষের আমানত, তা রক্ষা করতে হবে।
তিনি বলেন, ব্যাংক একাউন্ট হচ্ছে জনগণের আমানত। ব্যাংক হিসাব দেখার এখতিয়ার একেবারে না থাকা-ই ভালো, একদম ইমার্জেন্সি ছাড়া। ব্যাংকের ওপর হিসাবধারীর যে কনফিডেন্স তাকে নষ্ট করা যাবে না।
এক লাখ টাকার বেশি লেনদেনের ক্ষেত্রে টিআইএন বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দিয়ে ফরাসউদ্দিন বলেন, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটা প্রস্তাব আমরা সরকারকে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম এক লাখ টাকার বেশি নগদ লেনদেন করতে হলে টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হোক। সরকার রাজি হয় নাই।
অনলাইনে লেনদেনকে করের আওতায় আনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, মেইল অর্ডার বাণিজ্য বিত্তবান লোকেরা করে। ছাপোষা লোকেরা করে না। এখন দোকানে দোকানে ভিড় কম। কারণ মেইল অর্ডারে বেশি কেনা-বেচা হচ্ছে। এর উপরে ট্যাক্স মেকানিজম করার জন্য এনবিআরকে আমি গত পাঁচ বছর ধরে পরামর্শ দিচ্ছি। কিন্তু এই ক্ষমতা তাদের হাতে নাই।
এটা করতে পারলে ট্যাক্স আদায় অনেক বেশি হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এটা খুব ন্যায়সঙ্গত। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যেখানে মেইল অর্ডারের ওপর ট্যাক্স নেই।’
তামাকের ওপর কর নিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বেশি দামের সিগারেটের ওপর অনেক কর অলরেডি আছে। কিন্তু ফ্যাশনেবল হচ্ছে এর ওপর কর বাড়িয়ে দেয়া। কিন্তু ট্যাক্স আহরণ বাড়ানোর জন্য বেশি লাভ হবে না। তবে মানুষ অতিরিক্ত দাম বাড়ার কারণে যদি ধূমপান ছেড়ে দেয় তাহলে লাভ হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সমাজ আপনাকে ধন্য ধন্য দেবে।
জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ক্ষেত্রে সরকারের নীতির সমালোচনা করে ফরাসউদ্দিন বলেন, দেশের ৬৫ ভাগ মানুষ কেরোসিন ব্যবহার করে, ওইখানে কমাবেন বেশি করে। অকটেনের দাম কমে কিন্তু কেরোসিনের দাম কমে না। কি আশ্চর্য! অকটেন যারা কেনেন তাদের জন্য ১০ টাকা বাড়ালে কিচ্ছু যায় আসে না।
আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় দেশে জ্বালানি তেলের বেশি দামের কারণে যারা অতিরিক্ত মুনাফা করছে তাদের ধরার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, দাম বাড়ানোর ফলে এবং আন্তর্জাতিকবাজারে দাম কমার ফলে হাজার হাজার কোটি টাকার মুনাফা এখন যারা করছেন তাদেরকে ধরেন। তাদেরকে বলেন, তোমরা যে এই অতিরিক্ত মুনাফা পাচ্ছো তার অর্ধেক আমাকে দাও। এনবিআরকে দাও।
বিকল্প ব্যবস্থায় বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) ক্ষেত্রে কর কমিশনারদের সব সময় জেতার মানসিকতা থেকে সরে আসার আহ্বান জানান ফরাসউদ্দিন।
ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের একজন মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ৬৮৭ টাকা। আজকে একজন নাগরিকের মাথাপিছু আয় এক লাখ তিন হাজার ৮৭৬ টাকা। অর্থনীতির পরিধি বেড়েছে ১৭৪ গুণ। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৭৫ ভাগ। ১৯৭২ সালে কর আদায় হয়েছে ১৬৬ কোটি টাকা। বাজেট ছিল ৭৮২ কোটি টাকা। বাজেট আজকে আড়াই লাখ কোটি টাকা। তিনি গত অর্থবছরে কর আদায় হয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করায় এনবিআরকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান।
তিনি বলেন, চার কোটি পরিবার হলে কেন আমরা ১০ ভাগ লোকের কাছ থেকে কর নিতে পারি না। কেন তাদের বুঝাতে পারি না। দোষ কাদের? সম্পূর্ণ কর-বান্ধব একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে, ভালোভাবে বুঝাতে হবে দেশকে গড়ে তোলার জন্য তিনি কর দিচ্ছেন। জনগণ কর দিচ্ছেন বলে দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হচ্ছে। রাজস্ব আহরণের ফলে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু হচ্ছে। রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি পেলে দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠতে সময় লাগবে না।
সভাপতির বক্তব্যে এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেন, এনবিআর সরকারের কয়েকটি লক্ষ্য পূরণে কাজ করছে। সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে জনমুখী ব্যবস্থাপনা চালু করেছে। তার আওতায় সরকার জনগণের ওপর করের বোঝা না বাড়িয়ে কর নেট সম্প্রসারণে উদ্যোগী। তারই ধারাবাহিকতায় করদাতার সংখ্যা দিন দিন বেড়ে এখন ২৭ লাখ ১৮ হাজারেরও বেশি হয়েছে।
‘মার্চ মাসকে এডিআর শক্তিশালী’ করার মাস ঘোষণা করে চেয়ারম্যান বলেন, এডিআরকে শক্তিশালী করা একটি চ্যালেঞ্জ। মার্চ মাসে এডিআর শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি কাজ করবে এনবিআর।
করদাতাগণকে কোনো ধরণের হয়রানি না করার নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘কর প্রশাসনের সব ক্ষেত্রে শুদ্ধাচার সুনিশ্চিতের মাধ্যমে নির্ধারিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে উপ-কর কমিশনারদের উন্নয়নের অক্সিজেন রাজস্ব সংগ্রহের কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হবে।’
একই অনুষ্ঠানে এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ বলেন, রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর জন্য এনবিআরকে ব্যবসায়ীদের প্রতি হুঙ্কার পরিহার করে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে কেউ অসৎ বা অস্বচ্ছ থাকলে এনবিআর ফেডারেশনে এসে বলুন, আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। একই সাথে আপনারাও স্বচ্ছ হোন।