বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-মহিলা বিষয়ক সম্পাদক এবং জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডাভোকেট শিরিন সুলতানা। নিজের ইচ্ছায় তিনি ইডেন কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্রদলে নাম লিখিয়েছিলেন। এখনো বিএনপিকে আঁকড়ে রয়েছেন। বিয়ে করেছেন তার রাজনৈতিক সহকর্মী খায়রুল কবির খোকনকে। বর্তমানে তার স্বামী দলের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক। স্বামী-স্ত্রী দুজনই এমপি হয়েছেন। বিএনপিতে বেগম খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন হিসেবে যে গুটিকয়েক নাম আসে তারমধ্যে শিরিন সুলতানা অন্যতম। ছাত্রজীবন থেকেই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছিল তার জোরালো অবস্থান।
তার সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে আসে দলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কথা। জানালেন, চলতি বছরের মধ্যে দল পুনর্গঠন সম্পন্ন করতে চায় বিএনপি। এ লক্ষ্যে তাদের সংশ্লিষ্ট নেতারা আনুষ্ঠানিকভাকে কাজ শুরু করেছেন। চলছে হোম ওয়ার্ক। দলটির সব পর্যায়ে ৩৩ ভাগ নারী সদস্য রাখার প্রক্রিয়াও চলছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান সরাসারি রাজনীতিতে আসছেন বলেও তিনি আভাস দেন।
বর্তমান নারী নির্যাতন নিয়েও কথা বলেন এ নেত্রী। তবে লেজুড়বৃত্তি রাজনীতির কারণে বর্তমানে কিছু নারী সংগঠন নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে জোড়ালো আওয়াজ তুলছে না বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। শিরিন সুলতানার কথোপকথোনের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো
আপনি কীভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হলেন?
শিরিন সুলতানা: ছাত্র অবস্থা থেকেই আমি রাজনীতিতে সক্রিয়। যখন ইডেন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই তখন থেকেই অল্প অল্প করে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিলাম। বিভিন্ন প্রোগ্রামেও যেতাম। ৮২’ পর ইডেনে কোনো সাংগঠনিক কমিটি ছিল না। তাই অমি নিজে গিয়ে ইডেন কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হই। মানে আমাকে কেউ রিক্রুট করেনি। আমিই নিজ থেকেই রাজনীতিতে এসেছি। পরে ইডেনের কনেভনার কমিটি করে দেয়া হয়।
কমিটিতে আপনার কী পদ ছিল?
প্রথম আমি ইডেন কলেজে কনভেনার হিসেবে জয়েন করি। আমাকে বলা হলো তুমি মেয়েদের নিয়ে আসো। আমি তখন ইডেন কলেজ থেকে এক দেড়শ মেয়ে ডাকসু ভবনের ওখানে যাই। তাদের নিয়ে ডাকসুর সামনে ঘাসের ওপর বসা হলো। দ্বিতীয় দিন ডাকসু ভবনে বসে একটি কনেভনার কমিটি করে দেন নেতারা।
নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সকল পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ ভাগ নারী সদস্য রাখার যে বিষয় রয়েছে সেক্ষেত্রে আপনার দল কতটুকু বাস্তবায়ন করছে?
নারীর ক্ষমতায়নের মেইন যে অগ্রগতি সে তো আমার দল থেকেই শুরু হয়েছে। কারণ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় এলেন তখন তিনিই তো সর্বপ্রথম নারী আসন ১৫ থেকে ৩০-এ উন্নীত করেন। তিনিই প্রথম নারী অ্যাম্বাসেডর নিয়োগ করেন। তার সময় দুজন মহিলা মন্ত্রীও ছিলেন। তিনি মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনামলে আমরা দেখেছি যে, মেয়েদের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করার জন্য সারাদেশে জাতীয় মহিলা সংস্থা গঠন করতে। আমি মনে করি, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই প্রথম উদ্যোক্তা।
গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী আনসারেও মহিলা নিয়োগ হয়েছে। এভাবে হঠাৎ করে নতুন একটা অধ্যায়ের জন্ম শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ই শুরু হয়। সেটা বেগম খালেদা জিয়ার সময় বিস্তৃতি লাভ করে। আপনারা দেখেছেন যে, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, বয়স্ক শিক্ষা বেগম জিয়ার আমলেই বিস্তৃতি লাভ করে। খালেদা জিয়ার শাসনামলে গ্রামের স্কুলের দিকে তাকালে চোখে পড়েছে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের শিক্ষা। যে কারণে ভারতের অর্থনীতিবীদ নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন- বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিৎ। বাংলাদেশে যে গ্রামগঞ্জে শিক্ষার একটা অভূতপূর্ব সাড়া। আমাদের মানুষের চিন্তা চেতনায় ছিল ছেলেরা লেখাপড়া শিখবে, মেয়েরা তো অন্যের ঘরেই চলে যাবে। তাই মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে লাভ নেই। এই বিষয়টি বেগম খালেদা জিয়া উপলব্ধি করে মেয়েদের শিক্ষার প্রতি জোর দেন। মেয়েদের দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অবনৈতিক শিক্ষা চালু করেন। উপবৃত্তি চালু করেন। এর মাধ্যমেই নারী শিক্ষার প্রসার লাভ করে। যে কারণে মেয়েরা এতোদূর এগিয়ে আসতে পেরেছে বলে আমি বিশ্বাস করি।
বিএনপির সকল পর্যায়ের কমিটিতে তো ৩৩ ভাগ নারী সদস্য নেই। এ বিষয়ে আপনাদের অগ্রগতি কতটুকু?
২০২০ সাল নাগাদ ধাপে ধাপে ৩৩ ভাগ নারী সদস্য করার কথা রয়েছে। গত জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে ৩৩ ভাগ অনুযায়ী কিন্তু আমাদের নারী সদস্য রাখা হয়েছে। অলরেডি আপনি জেনে থাকবেন, আমাদের দল থেকে জেলা ও থানা কমিটিতে কমপক্ষে ২০ ভাগ নারী সদস্য রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এখন যে নতুন কমিটিগুলো হচ্ছে সেখানে কিন্তু সে হারেই নারী সদস্য রাখা হচ্ছে।
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামে কী পর্যাপ্ত নারী সদস্য আছে?
আমাদের যেহেতু স্ট্যান্ডিং কমিটিতে এখন একজনমাত্র নারী। তবে হঠাৎ করে বললেই তো হবে না। একটা পর্যায় থেকে উঠে আসতে হবে। যেমন আমরা ৩৩ ভাগ নারী চাই। আমরা নারীরাও কিন্তু হঠাৎ করে অতোটা প্রস্তুত না। সেই ধরনের নারী কিন্তু আমরা এখন পাচ্ছিও না। হয়তো চার-পাঁচ বছর গেলে সেভাবে পাওয়া যাবে। আগামী কাউন্সিল যেটা হচ্ছে আশা করি ৩৩ ভাগের বিষয়টি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করা হবে।
কিসের অভাবে ছাত্রদলে আমানউল্লাহ আমান বা খায়রুল কবির খোকনের মতো ছাত্রনেতা তৈরি হচ্ছে না?
অভাব আসলে… এটাতো এখনকার নেতৃত্বকে আমি বলবো না। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে এই শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা যখন ছাত্রদল করেছি তার পরবর্তী সময়ে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এরশাদ সরকারের পতন হয়েছে এবং বেগম খালেদা জিয়ার সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকারি দল হওয়ার কারণে একটা শূন্যতা তখন কিন্তু আস্তে আস্তে তৈরি হয়েছিল। আর ওই শূন্যতার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আজকে ছাত্রদলে বড় ধরনের শূন্যতা লক্ষ্য করছি। এটার জন্য বর্তমান নেতৃত্ব বা তার আগের নেতৃত্বকে দায়ি করবো না। ছাত্রসংসদ নির্বাচন না হওয়াও আরো একটা বড় কারণ। এছাড়া বছর বছর আমাদের ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কমিটি প্রদান প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ার কারণেও ছাত্রদলে শূন্যতা তৈরি হয়েছে বলে আমি মনে করি।
জোবাইয়দা রহমানের কি এখনই সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া উচিৎ?
আমাদের নেত্রী যেহেতু এখনো দলের চেয়ারপারসন এবং তারেক রহমান সিনিয়র ভাইস চেয়ারপারসন সেহেতু উনি রাজনৈতিক পরিবারেই রয়েছেন। সুতরাং জোবইয়াদা রহমান টুডে অর টুমরো তো রাজনীতিতে আসতেই পারেন। আর সময় হলে নিশ্চয়ই তিনি রাজনীতিতে সরাসরি চলে আসবেন।
বিএনপি পুনর্গঠনে আপনার প্রত্যাশা কী?
আমরা তো এবার আশাবাদী। সারাদেশের মানুষও আশাবাদী। অবশ্যই নতুন পুরাতনের সমন্বয়ে এবার কমিটি হবে। যাদের দলের জন্য সত্যিকার অর্থে ত্যাগ রয়েছে, দলের জন্য যাদের শ্রম রয়েছে, কষ্ট রয়েছে তারা নেতৃত্বে আসবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।
দলে বিতর্কিত এবং নিস্ক্রিয় নেতাদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ?
দলের মধ্যে যারা তাদের দায়িত্ব পালন করেননি বা নিস্ক্রিয়তা দেখিয়েছেন আমি মনে করি দলের এই ক্রান্তিলগ্নে নীতি নির্ধারণী ফোরামে যারা আছেন তারাই মূলত এই দায়িত্ব পালন করবেন। তারাই এখানে ভূমিকা রাখবেন। আমি মনে করি, তৃণমূলের কথা বিবেচনা করা হবে। দেশের জনগণের কথা চিন্তা করে অবশ্যই তারা সঠিক এবং যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন।
ভারতের চলন্ত বাসে ধর্ষণের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে যে জোরালো আন্দোলন হয়েছিল। অথচ বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনায় জোরালো প্রতিবাদ দেখা যায় না কেন?
নারী সংগঠনগুলো… আমরা কিছু প্রোগ্রাম করেছি। কয়েকদিন আগে মানবন্ধন করেছি,গত সপ্তাহে। তাছাড়া বিএনিপর কার্যক্রম করাটাই যেন সবচেয়ে কঠিন। সেখানে জনগণের ইস্যু, হোক আর দলীয় হোক সরকারি বাধার সম্মুখীন হতে হয়। তারপরও আমরা যখনই সুযোগ পাচ্ছি তখনই প্রোগ্রাম করছি।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো যে, এ বিষয়ে নারী সংগঠনগুলো নীরব রয়েছে। আমরা দেখছি এ ব্যাপারে তারা কোনো রকম দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছেন না। এটা খুবই দুঃখজনক। অথচ আমাদের সরকারের সময় যখন এ ধরনের ঘটনা হতো অন্যান্য নারী সংগঠনগুলো যেভাবে স্বোচ্চার থাকতো এখন কিন্তু সেভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এবং আমার কাছে মনে হচ্ছে এরা দলীয় লেজুড়বৃত্তি রাজনীতিকরার কারণে নারী সংগঠনগুলো একদমই নীরব রয়েছে। কিন্তু আমরা এটা প্রত্যাশা করি না।একজন নারী সংগঠক হিসেবে, বিবেকবান নারী হিসেবে মনে করি সবারই এর প্রতিবাদ করা উচিৎ। কে কোন দল করি সেটা কোনো বড় কথা নয়।
আমি যখন ছাত্ররাজনীতি করি তখন শারমিন রিমা হত্যা, আমার এলাকায় ফুল নামে একটা মেয়ে হত্যা, এই ধরনের ঘটনায় দলমত নির্বিশেষে ভূমিকা রেখেছি। আমরা এখনো রাখতে চাই। কিন্তু মুখচেনা কিছু নারী সংগঠন রয়েছে তারা আশ্চর্যজনকভাবে একদম নীরব। এদের ভূমিকাও বিতর্কিত। আমি মনে করি এদেরকে সামনে এগিয়ে আসা উচিৎ। নারী হিসেবে তাদের দায়িত্ব পালন করা উচিৎ।
বিএনপির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া কতদিনের মধ্যে শেষ হবে?
পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। কিছু হোম ওয়ার্ক চলছে। আশা করছি এ বছর জাতীয় কাউন্সিল হবে। জাতীয় কাউন্সিলের আগেই ইনশাআল্লাহ শেষ হবে।
আপনার দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের দুই সদস্য মওদুদ আহমেদ এবং মাহাবুবুর রহমানের বক্তব্যে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তাতে আপনার নেতাকর্মীদের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে?
না। মওদুদ সাহেব পরবর্তীতে নিজেই এর প্রতিবাদ করেছেন। মাহাবুবুর রহমান সাহেবের বক্তব্য আমি শুনিনি। বর্তমান সরকার আমাদের বিরুদ্ধে নানা প্রক্রিয়ায় ষড়যন্ত্র করছে। কিছু মিডিয়া রংচং দিয়ে খবর দিচ্ছে, দলকে দুর্বল করা, নেতাকর্মীদের দ্বিধাগ্রস্ত করা যা সরকারের ষড়যন্ত্রের অংশ। অতীতেও বিএনপি দুঃসময়ে পড়েছে। তৃণমূল নেতাকর্মীরা সঠিক সিদ্ধান্ত চিন্তা দিয়ে কষ্ট করে ভালোবাসা দিয়ে দলকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।
বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ হচ্ছে কেন?
কোনো আন্দোলন ব্যর্থ হয় না। কোনো কোনো আন্দোলন সময় লাগে। সময়টা হলোফ্যাক্টর। এখানে আন্দোলনে সফলতা ব্যর্থতা বড় কথা না। ৯০’র আন্দোলন একবারে হয়নি। ৯ বছরসাড়ে ৯ বছরের প্রক্রিয়া। ১/১১ পর থেকে দল ঘুরে দাঁড়িয়েছে আবার ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে। একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দল আছে। যখন আন্দোলনের সফলতা আসবে তখন আপনারাই মূল্যায়ন করবেন যে, এটা সফলতারই ধারাবাহিকতা। আপাতত ব্যর্থ দেখা গেলেও এর ধারাবহিকতায় সফলতা আসবে। তখন আন্দোলনের ফসল হিসেবে বিবেচিত হবে।
রাজনীতি নিয়ে লিখছিলেন, তার খবর কী? আগামী বই মেলায় কি কোনো বই পাওয়া যাবে আপনার?
লিখছি, বই মেলা নয়, আশা করি তার আগেই পত্রিকায় দিতে পারবো।