গ্যাসের অবৈধ সংযোগ আছে, চুরি ও অবৈধভাবে চাপ বাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে, বন্ধ হয়নি অপচয়ও। এরপরও দেশে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো ‘সিস্টেম গেইন’ করছে। অর্থাৎ তারা গ্যাস উৎপাদন বা উত্তোলন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে যে পরিমাণ গ্যাস কিনছে, গ্রাহক পর্যায়ে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ বিক্রি করছে।
আবাসিক খাতের গ্রাহকদের অব্যবহৃত গ্যাস এবং শিল্পে বেশি চাপের গ্রাহকদের অপেক্ষাকৃত কম চাপের গ্যাস সরবরাহ করে এ সিস্টেম গেইন করছে ছয়টি বিতরণ কোম্পানির সবগুলো। আর বৈধ গ্রাহকরা পরিশোধকৃত অর্থের বিপরীতে প্রাপ্য গ্যাস পাচ্ছেন না। বঞ্চনা ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন তারা। অথচ সিস্টেম গেইনের মত অস্বাভাবিক একটি বিষয়কে প্রায় স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। গ্যাস বিক্রি করেও তারা মুনাফা অর্জন করছে। এরপরও নিত্য ব্যবহৃত ও অপরিহার্য সেবাপণ্যটির দাম বাড়ানোর জন্য তাদের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, দেশে বিতরণকৃত মোট গ্যাসের ১৩ শতাংশ গৃহস্থালীতে, ১৭ শতাংশ শিল্পে, ৬ শতাংশ সার কারখানায় এবং সিএনজিতে সাড়ে ৫ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া বিদ্যুৎ উত্পাদনে ৪১ শতাংশ এবং ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উত্পাদনে ১৭ শতাংশ গ্যাস ব্যবহৃত হয়।
সম্প্রতি বিইআরসিতে জমা দেয়া বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব ও হিসাবের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ১ দশমিক ৮২ শতাংশ, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ৪ শতাংশ, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ, কর্ণফুলী ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির সিস্টেম গেইন ছিল ৫ শতাংশ। চলতি অর্থ বছরেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। এর আগের কয়েক বছরও কোম্পানিগুলো পদ্ধতিগত লোকসান বা সিস্টেম লস না করলেও সিস্টেম গেইন করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত: দুই ভাবে এই সিস্টেম গেইন ও গ্রাহক বঞ্চনার ঘটনা ঘটছে। এক. লাইনে চাপ কম থাকায় শিল্প-বাণিজ্য খাতের গ্রাহকরা তাদের জন্য বরাদ্দকৃত চাপ অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছেন না। পুরনো ভলিউমেট্রিক মিটারের কারণে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান কতটুকু কম গ্যাস পাচ্ছেন তা ধরা পড়ে না। কিন্তু গ্যাস কোম্পানিগুলো বরাদ্দকৃত চাপ অনুযায়ী গ্যাস বিতরণের পরিমাণ নির্ধারণ করে বিল জারি করে। দুই. আবাসিক গ্রাহকেরা যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করবেন বলে হিসাব করে কোম্পানিগুলো দাম নির্ধারণ করেছে, আসলে আবাসিক গ্রাহকেরা তার চেয়ে অনেক কম গ্যাস ব্যবহার করেন। যেমন, দুই চুলার একজন গ্রাহক প্রতি মাসে ৯২ ঘনফুট (সিএফটি) গ্যাস ব্যবহার করবেন এমন ধারণা করে বিল নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু তারা মূলত: গড়ে ৪২ সিএফটি গ্যাস ব্যবহার করে। ফলে সিস্টেম গেইন হয় দ্বিগুণেরও বেশি। আবাসিকে যে সকল গ্রাহকরা প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করছেন তারা চুলা অনুযায়ী নির্ধারিত গ্রাহকদের চেয়ে কম বিল পরিশোধ করেন।
পেট্রোবাংলা ও তিতাস গ্যাস কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা জানান, দেশে প্রায় ২০ লাখ আবাসিক সংযোগ রয়েছে। আবাসিক গ্রাহকের অন্তত ৭০ ভাগ তাদের বেঁধে দেয়া সীমার চেয়ে কম গ্যাস ব্যবহার করেন। এর কারণে বিপুল পরিমাণ গ্যাস উদ্বৃত্ত থাকে। এই উদ্বৃত্ত গ্যাস দিয়েই সিস্টেম লস ও চুরিকৃত গ্যাসের বিষয়টি লুকিয়ে রাখে কোম্পানিগুলো। আর এই অপকর্মে জড়িত থাকে কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, কর্মচারী ও ঠিকাদাররা।
এ প্রসঙ্গে তিতাস গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মসিউর রহমান বলেন, আবাসিকের বেশ কিছু গ্রাহক সংযোগ নিলেও তেমন ব্যবহার করে না। আবার শিল্পের গ্রাহকদের যে চাপ অনুযায়ী গ্যাসবিল করা হয় দিনে তিন-চার ঘন্টা তার চেয়ে কম চাপে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। কিন্তু একই চাপের মাপকাঠি ধরে ২৪ ঘণ্টার বিল করা হয়। এ জন্যই এ সিস্টেম গেইন হচ্ছে। বড় গ্রাহকদের ক্ষেত্রে কম্পিউটারভিত্তিক মিটার স্থাপন করা হয়েছে। তাই তারা যে চাপ অনুযায়ী বিল দিচ্ছেন সে অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছেন।
জানা যায়, সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি তিতাসে অবৈধ গ্যাস সংযোগের পরিমাণও বেশি। ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী ১৪ জেলার কয়েক হাজার কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস পাইপলাইন রয়েছে। এগুলো উচ্ছেদে ২০১৪ সাল থেকে কাজ শুরু করে একটি টাস্কফোর্স। গত নভেম্বর পর্যন্ত এ টাস্কফোর্স ৮২০ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন উচ্ছেদ করেছে। ২০১৩ সালে তিতাসের হিসেবেই এর আওতাধীন এলাকায় অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে চার লাখ। তিতাসের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় ঠিকাদাররা এসব সংযোগ দিয়ে বিলও আদায় করে। শুধু তিতাসই নয় অন্য বিতরণ কোম্পানিগুলোর এলাকায়ও অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার বা সরাসরি চুরির অভিযোগ রয়েছে। ফলে দেখা যায়, বিতরণ কোম্পানিগুলো পেট্রোবাংলার কাছ থেকে যে পরিমাণ গ্যাস কিনছে মাস বা বছরশেষে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ গ্যাস বিক্রির বিল তাদের হিসাবে জমা হচ্ছে।
কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, সিস্টেম গেইন নামক এই গ্রাহক বঞ্চনা ও প্রতারণার বিষয়ে আমরা বিইআরসিসহ সরকারের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের কাছে অভিযোগ করেছি। কিন্তু এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। এ ব্যাপারে কাউকে আন্তরিক বলেও মনে হচ্ছে না। অবৈধ সংযোগ ও চুরি বন্ধের চেয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ব্যাপারেই যেন সংশ্লিষ্টদের বেশি আগ্রহ। অথচ এ মূহুর্তে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতাই নেই।
এদিকে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ হলেও অবৈধ সংযোগ বন্ধ হচ্ছে না। বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকরা অভিযোগ করেছেন, কোম্পানিগুলোর আঞ্চলিক অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের যোগসাজশে গৃহস্থালীতে অবৈধ সংযোগ চলছেই। এ প্রসঙ্গে টঙ্গীর দত্তপাড়ার বাসিন্দা ও ইতালি প্রবাসী মো. হাবিবুল্লাহ জানান, গত শুক্রবার তার বাড়ির কাছে রাস্তা কেটে একটি অবৈধ সংযোগ পাইপ স্থাপন করা হয়েছে। তার বাড়ির কাছের একটি বিতরণ পাইপ থেকেই ওই অবৈধ সংযোগ নেয়া হয়েছে। তিতাস গ্যাসের স্থানীয় কর্মকর্তাদের কাছে তিনি এ বিষয়ে অভিযোগ করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিষয়ে তিতাস গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান চলছে। এরপরও বেশ কিছু স্থানে নতুন অবৈধ সংযোগ দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা এ অবৈধ সংযোগ বন্ধের ব্যাপারে আন্তরিক না হলে এটি শতভাগ বন্ধ করা যাবে না।