১৫ আগস্টের কালরাতে শাহাদতবরণকারী সবার প্রতি আমার শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছি। এই দিনে জাতির জনককে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ঘাতক খুনিচক্র স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল দেশের অগ্রগতিকে। ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সব অর্জনকে। এ দিন শুধু জাতির জনককেই হত্যা করা হয়নি, মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ও লক্ষ্যকে ভিত্তি করে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন পূরণের নেতৃত্বকে হত্যা করা হয়েছিল। ঘাতকদের লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর রক্তের কোনো উত্তরাধিকার যেন বেঁচে না থাকে। আর সেজন্যই তারা বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠপুত্র ১০ বছরের শিশু রাসেলকেও রেহাই দেয়নি। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, পরম করুণাময়ের অশেষ কৃপায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে থাকায় সেদিন ঘাতকের হাত থেকে প্রাণে রক্ষা পান। আজ গর্ব করে বলতে পারি ষড়যন্ত্রকারী খুনিচক্রের সেই আশা সফল হয়নি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ করে বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে তার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেত্রীত্বে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলেছে দৃপ্ত পদক্ষেপে।
বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কত কথা, কত স্মৃতি আজ মনের চারপাশে ভিড় করে আসে। মনে পড়ে ১৯৭১-এর রক্তঝরা মার্চের ১৭ তারিখের কথা। সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে দুপুরে ধানমণ্ডির বাসভবনে বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচেয়ে বড় ও পবিত্র কামনা কী?’ উত্তরে বঞ্চিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ এরপর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে তিনি ব্যথাতুর কণ্ঠে বেদনার্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না- আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নেই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যে কোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু।’ কত বিশাল হৃদয়ের, মহৎ মনের অধিকারী মানুষ ছিলেন তিনি! বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিতি হওয়ার পর থেকে আমি তার অপার স্নেহ-ভালোবাসায় ধন্য। তিনি সবসময় আমাকে কাছে রাখার চেষ্টা করতেন। প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হওয়ার সুবাদে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে। আজ স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে সেসব দিনগুলোর দৃশ্য। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিশ্বসভায় বঙ্গবন্ধু মুজিব ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন হয়েছেন। সে সময় বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করেছে- ‘কমনওয়েলথ অব নেশনস্’, ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন’, ‘ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা’ ও ‘জাতিসংঘ’। এ সম্মেলন ও অধিবেশনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রতিটি সম্মেলন ও অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর। মুক্তিযুদ্ধের পরমমিত্র প্রতিবেশী ভারতের কলকাতা মহানগরীর ব্রিগেড ময়দানে ২০ লক্ষাধিক মানুষের মহাসমুদ্রে তিনি বক্তৃতা করেছিলেন। সে কী বক্তৃতা! কলকাতার মানুষ সেদিন বাড়িঘর ছেড়ে জনসভায় ছুটে এসেছিল। সভাশেষে রাজভবনে যখন দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়, তখন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার জন্মদিন ১৭ মার্চ। আপনি সেদিন বাংলাদেশ সফরে আসবেন; কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার সফরের আগেই আমি চাই আপনার সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেবেন।’ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সম্মতি জানিয়েছিলেন। ১৭ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী বাংলার মাটি স্পর্শ করার আগেই ১২ মার্চ বিদায়ী কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিল। তারপর ৬ মার্চ ছিল মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্রদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর। মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের সার্বিক সমর্থন জুগিয়েছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে ‘ভেটো’ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিল। সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন এবং ক্রেমলিনে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মি. পদগর্নি বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। ১৯৭৩-এর ৩ আগস্ট কানাডার রাজধানী অটোয়াতে ৩২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কমনওয়েলথ সম্মেলন। কিন্তু সব নেতার মাঝে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিনের সেই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো। বঙ্গবন্ধু সেদিন বক্তৃতায় বৃহৎশক্তিবর্গের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘হোয়েন এলিফ্যান্ট প্লেস, গ্রাস সাফারস।’ তার এ বক্তৃতা উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। সেই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডোয়ার্ড হিথ্, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী মি. হুইটলাম, তাঞ্জানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নায়ারে, জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনেথ কাউন্ডা, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট জমু কেনিয়াত্তা, সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী মি. লি কুয়ান, শ্রীলংকার শ্রীমাভো বন্দরনায়েকেসহ বিশ্বের বরেণ্য সব নেতা।
১৯৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে ছয়জন নেতার নামে তোরণ নির্মিত হয়েছিল। তন্মধ্যে জীবিত দু’নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অন্যজন মার্শাল জোসেফ ব্রোঞ্জ টিটো। আর প্রয়াত চারজন নেতা ছিলেন মিসরের জামাল আবদুল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকর্ণ, ঘানার প্রেসিডেন্ট কাউমি নক্রুমা এবং ভারতের পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু। আলজেরিয়ার মঞ্চে দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ ১৯৭৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারি যেদিন তিনি ইসলামিক সম্মেলনে যান, সেদিন লাহোর বিমানবন্দরে দেখেছি, যে দেশ মুক্তিযুদ্ধে আমার দেশের নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের ওপর গণহত্যা চালিয়ে ৩০ লক্ষাধিক মানুষ শহীদ করেছে, সেই দেশের মানুষ রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে স্লোগান তুলেছে ‘জিয়ে মুজিব জিয়ে মুজিব’, অর্থাৎ মুজিব জিন্দাবাদ মুজিব জিন্দাবাদ। তখন অবাক হয়েছি। লাহোরে এ সম্মেলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এমনকি যতক্ষণ তিনি লাহোরে না পৌঁছেছেন, ততক্ষণ সম্মেলন শুরুই হয়নি। বঙ্গবন্ধুর জন্য একদিন সম্মেলন স্থগিত হয়েছিল। সালিমার গার্ডেনে যখন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের গণসংবর্ধনা দেয়া হয় সেখানেও সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু এমন আত্মমর্যাদাবান নেতা ছিলেন যে, সেদিন সৌদি বাদশাহের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বলেছিলেন, ‘ইউর ম্যাজেস্টি, আপনি আমাকে স্বীকৃতি না দিয়েও আমার দেশের মানুষকে হজব্রত পালনের সুযোগ দিয়েছিলেন বলে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।’ যুগোশ্লাভিয়ায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েছিলাম। যুগোশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রনায়ক মার্শাল টিটো বিমানবন্দরে তাকে বীরোচিত অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। সে কী দৃশ্য!
জাপান সফরে দেখেছি দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকা বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। মিসরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। বিশেষভাবে মনে পড়ে ১৯৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বরের কথা। যেদিন জাতির জনক জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক অনন্য ও মহত্তর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করবেন।’ কিন্তু প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও মমত্ববোধ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।’ যখন বক্তৃতা প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষিত হয়, তখন বিশ্ব নেতাদের মুহুর্মুহু করতালিতে চারদিক মুখর হয়ে ওঠে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চতুর্দিকে তাকিয়ে পরিষদে সমাগত বিশ্বনেতাদের বিনম্র সম্বোধন জ্ঞাপন করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সর্বোচ্চ সংস্থা জাতিসংঘকে ‘মানবজাতির মহান পার্লামেন্ট’ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতা শুরু করেন। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘শান্তি ও ন্যায়ের জন্য পৃথিবীর সব মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বিমূর্ত হয়ে উঠবে এমন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ আজ পূর্ণ অঙ্গীকারাবদ্ধ। জাতিসংঘের সনদে যেসব মহান আদর্শ উৎকীর্ণ রয়েছে তারই জন্য আমাদের দেশের লাখ লাখ মানুষ চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে।’ পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে বঙ্গবন্ধু ৪৫ মিনিট বক্তৃতা করেন। বক্তৃতার শেষে সভাপতি নিজেই যখন দাঁড়িয়ে করতালি দিচ্ছেন, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বিপুলভাবে করতালি দিয়ে আলিঙ্গন করে অভিনন্দিত করেছেন বঙ্গবন্ধুকে। অভাবনীয় সেই দৃশ্য!
বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্ব নেতাদের ছিল গভীর শ্রদ্ধা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিমালয়সম উচ্চতায় আসীন ছিলেন তিনি। আমার মনে পড়ে, অধিবেশনে আগত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা আমাদের কাছে এসে বলেছিলেন, ‘সত্যিই তোমরা গর্বিত জাতি। তোমরা এমন এক নেতার জন্ম দিয়েছো, যিনি শুধু বাংলাদেশের নেতা নন-এশিয়ার নেতা নন, তিনি সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা।’ জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার রাষ্ট্রনায়ক ফিডেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ বিশ্বে বিরল। যেখানেই গিয়েছেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। আমি মহাসৌভাগ্যবান, মহান নেতার সান্নিধ্যলাভ করেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ’৭৫-এর ১৪ আগস্ট। আমার বাসা ছিল ধানমণ্ডিতে। এখন যেখানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়, তার পাশেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের বাসভবন সেটিই তখন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিবের বাসভবন। প্রতিদিনের মতো সকালবেলা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে যাই। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গণভবনে গিয়েছিলাম। দিনের কাজ শেষে দুপুরবেলা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই টেবিলে বসে একসঙ্গে খেয়েছি। বাসা থেকে বঙ্গবন্ধুর খাবার যেত। পরম শ্রদ্ধেয়া বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গী। সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে বঙ্গবন্ধুকে যত্ন করে রাখতেন। নিজ হাতে রান্না করে বঙ্গবন্ধুকে খাওয়াতেন। খাবার শেষে বঙ্গবন্ধু বিশ্রাম নিলেন। এরপর এসে গণভবনে নিজ কক্ষে বসলেন। বঙ্গবন্ধু প্রায় প্রতিদিন বিকালে মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের সঙ্গে দৈনন্দিন রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করতেন। একসঙ্গে চা পান করতেন। এরপর রাত ৮টায় স্বীয় বাসভবনে ফিরতেন। বঙ্গবন্ধুকে পৌঁছে দিয়ে আমি বাসায় ফিরতাম। যেতামও একসঙ্গে, ফিরতামও একসঙ্গে। গণভবনে যেখানে বঙ্গবন্ধুর অফিস ছিল সেখানে তিনি দুপুর ২টা পর্যন্ত অফিস করতেন। গণভবনের পাশে এখন যেখানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিস সেটি ছিল বঙ্গবন্ধুর অফিস। সেদিন বঙ্গবন্ধুর যুগ্ম সচিব মনোয়ারুল ইসলাম এবং ব্যক্তিগত সচিব ফরাসউদ্দীন পিএইচডি করতে বিদেশ যাবেন এ উপলক্ষে কর্মকর্তাদের নৈশভোজ। নৈশভোজ শেষে তাদের বিদায় করে আমি আবার ৩২ নম্বরে এলাম। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তখন খাবার টেবিলে। বঙ্গবন্ধুর অফিস কক্ষের পাশেই আমার দফতর। সেদিন কাজ শেষে সবাইকে বিদায় করে আমি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে এলাম। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তখন খাবার টেবিলে। আমাকে কাছে ডেকে বললেন, ‘কাল সকালে আমার বাসায় আসবি। আমার সঙ্গে তোর প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাবি।’ আমার আর প্রিয় নেতার সঙ্গে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়া হয়নি।
২৩ আগস্ট গ্রেফতার হওয়ার পর ৩৩ মাস কারাভোগ শেষে যখন বেরিয়ে আসি, তখন দেখি জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি। আমরা তার সামরিক শাসনের মধ্যেই আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। ঢাকায় ১৯৮০ সালে রাজশাহী কারাগারে জেলহত্যার বিরুদ্ধে আমরা যে হরতাল কর্মসূচি দিয়েছিলাম, সেই মিছিলে আমি আর রাজ্জাক ভাই নেতৃত্ব দিয়েছি। সামরিক সরকার মিছিলের ওপর ট্রাক চালিয়ে দিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম। জিয়াউর রহমান ছিলেন নীতিহীন স্বৈরশাসক। তিনি প্রকাশ্যে জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘I will make politics difficult for politicians’ এবং এই নীতিহীন প্রচেষ্টায় সফল হয়েছেন। ক্ষমতা এবং নীতিহীনতা একত্রিত হলে যে কী হয়, সেদিন জিয়াউর রহমান তা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন! এরপর ’৭৯-এর যে নির্বাচন হল, আমি সেই নির্বাচনের বিরুদ্ধে ছিলাম। ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোটের মাধ্যমে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান যখন ৯৯ ভাগ ভোট পক্ষে নিলেন তখন আমরা শহীদ মিনারে শপথ নিয়েছিলাম, ‘সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের শাসনে নির্বাচন করব না।’ কারণ, আমরা ইঙ্গিত পেয়েছিলাম এই নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না। সামরিক শাসনকে বৈধতা দিতে জেনারেল জিয়ার প্রয়োজন একটি রাবারস্ট্যাম্প পার্লামেন্ট। এ ঘৃণ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে রাজনীতিবিদদের বেচাকেনার সামগ্রীতে পরিণত করে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে কলুষিত করতে জিয়াউর রহমান আরও ঘোষণা করেছিলেন, ‘Money is no problem’ এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দু’হাতে অর্থ ছড়িয়ে বহু রাজনীতিককে ক্রয় করে রাতারাতি ‘বিএনপি’ নামক দল খাড়া করলেন। অর্থ দিয়ে রাজনীতিকদের ক্রয় করার অসাধু প্রক্রিয়ায় জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে আমার কাছে বিভিন্নরকম অস্বস্তিকর প্রস্তাব আসতে লাগল। সেগুলো ছিল হীনস্বার্থ-সংবলিত প্রস্তাব। সেসব প্রস্তাব আমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি। আমাকে বঙ্গভবনে নেয়ার জন্য জিয়াউর রহমান বহু চেষ্টা করেছেন। আমি তার সঙ্গে কখনও দেখা করিনি। দেখা না করার বহু কারণ ছিল। আমি যখন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তখন তিনি আমার সঙ্গে একরকম ব্যবহার করতেন। এখন তিনি রাষ্ট্রপতি আর আমি একজন সাধারণ মানুষ। এখন তিনি আমার সঙ্গে আরেক রকম ব্যবহার করবেন। এ আরেক রকম ব্যবহার আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আমার ভালো লাগবে না বলেই আমি যাইনি। এমনকি বাজিতপুরের আমাদের দলের কয়েকজনের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল, জিয়াউর রহমানের কাছে যেতে হবে ফাঁসির দণ্ডাদেশ মওকুফের জন্য। রাজ্জাক ভাইসহ অন্যরা গেলেন, আমি যাইনি। রাজ্জাক ভাই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি যাবা না কেন?’ আমি বললাম, আমি যাব না। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করলে বদনাম হয়। বন্ধুত্ব করলে ফাঁসি হয়। এর কোনোটাই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়নি। আমি যখন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তখন তিনি প্রায়ই আমার দফতরে আসতেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার এক মাস আগে তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়ার জন্য। আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিলাম। বঙ্গবন্ধুর সামনে কোরআন শরিফ ছুঁয়ে শপথ নিলেন ভবিষ্যতে তিনি বেঈমানি করবেন না। তারপরে কী হয়েছে বাংলার মানুষ জানে। তাকে বিদেশে দূতাবাসে চাকরি দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। এটা যাতে না করা হয় সেজন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে সেই চেষ্টাই তিনি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দয়ালু মানুষের সামনে কোরআন শরিফ ছুঁয়ে শপথ করে বললেন, ‘আমি কোনোদিন আপনার সঙ্গে বেঈমানি করব না। আমাকে বিদেশে পাঠাবেন না। আমি আপনার এখানে আপনার সঙ্গে থাকতে চাই।’ বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে সেই আদেশ বাতিল করে দিলেন। আমিই সেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাকে দেখা করিয়ে দিয়েছিলাম। সেদিনের সেসব কথা মনে করে আমি কোনোদিন এ বিশ্বাসহন্তারক ঘৃণিত লোকটির সঙ্গে দেখা করিনি।
জিয়াউর রহমানের আমলে আমাদের ওপর অনেক নির্যাতন হয়েছে। আমাদের মিছিল-মিটিংয়ে আক্রমণ হয়েছে। সেসব উপেক্ষা করে প্রাণান্ত পরিশ্রম করে দলকে সংগঠিত করেছি, নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছি। সামরিক শাসনের মধ্যেও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে আমরা সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়েছি। ’৭৫-এর পর চরম দুঃসময়। দেশজুড়ে কারফিউ, হত্যা, গুম, গ্রেফতার আর ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা। অবর্ণনীয় করুণ অবস্থায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আমাদের কেটেছে। নিজের বাড়িতে থাকতে পারিনি। আমি যখন কারাগারে, আমার স্ত্রীকে কেউ বাড়িভাড়া দেয়নি। তোফায়েল আহমেদের স্ত্রীকে বাড়িভাড়া দিলে আর্মি ধরে নিয়ে যাবে। আমার ভাগ্নি জামাই নজরুলের নামে বাড়িভাড়া নিয়ে পরিচয় গোপন করে মাসিক দেড় হাজার টাকা ভাড়ায় সেই বাড়িতে আমার স্ত্রী থেকেছেন। তিনি এক বছর ছিলেন কলাবাগানে। সেই বাসায় কোনো ফ্যান ছিল না। পরে বরিশালের সাবেক এডিসি এমএ রবের কল্যাণে তার আজিমপুরের বাসার দোতলায় আমার পরিবারের ঠাঁই হয়। কারামুক্ত হয়ে ফিরে সেই বাসায় থেকেছি। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। সেই সময় করুণ অবস্থা গেছে আমার পরিবারের। আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মাত্র ২১ হাজার টাকা, স্ত্রীর নামে ৮ হাজার আর মেয়ের নামে ৪ হাজার টাকা। জিয়াউর রহমান এগুলো ফ্রিজ করেছেন। আমরা ওই টাকা তুলতে পারতাম না। আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দেয়ার বহু রকম চেষ্টা করেছেন। কোনো দুর্নীতি আবিষ্কার করতে পারেনি। কোনো মামলা দিতে পারেননি। কেরানীগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা বোরহানউদ্দীন গগনকে দলের সাংগঠনিক কাজ করার জন্য আমি সাধারণ একটা গাড়ি দিয়েছিলাম। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তিনি সেই গাড়ি ফেরত দিয়েছিলেন। অথচ সেই গাড়ির জন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আমার এ বনানীর বাড়ি, এ বাড়ির জমি বঙ্গবন্ধু আমাকে দিয়েছিলেন। ’৭৫-এর ৩০ জুলাই বরাদ্দ করে দিলেন আমার স্ত্রীর নামে। ১৫ আগস্টের পর আমি কারাগারে। ’৭৬-এ আমার স্ত্রী চিঠি পেলেন বরাদ্দকৃত প্লটের জন্য টাকা জমা দিতে হবে। আমার স্ত্রীর কাছে কোনো টাকা নেই। তখন তার ২৮ ভরি স্বর্ণ, যার থেকে ইতিমধ্যে ৪ ভরি বিক্রি করেছেন। ২৪ ভরি বন্ধক দিয়ে ভোলার সোনালী ব্যাংক থেকে ১৩ হাজার টাকা নিয়েছেন। কিন্তু প্রথম কিস্তি পরিশোধে লাগবে ১৭ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন রফিকুল্লাহ চৌধুরী। আজকে যিনি জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমীন চৌধুরীর পিতা। আমার এপিএস ছিল শফিকুল ইসলাম মিন্টু। আমি তাকে চাকরি দিয়েছিলাম ১৯৭৩ সালে। ১৫ আগস্টের পর আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার জন্য খুনিচক্রের ক্যাপ্টেন মাজেদের নেতৃত্বে কিছু সেনাসদস্য তাকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় মিন্টুকে হত্যা করে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়া হয়। তার মৃতদেহটি পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে আমরা সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে সব ভেদাভেদ ভুলে কেবল দলকেই ধ্যান-জ্ঞান করে, দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে আওয়ামী লীগের পতাকা তুলে দিয়েছি। তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে দলের সংগ্রামী পতাকা গৌরবের সঙ্গে সমুন্নত রেখেছেন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হওয়ার পর আমরা তাকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে যেখানেই গিয়েছি সেখানেই সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন পেয়েছি। ব্যাপক গণসমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করেছে সংবিধান ও সত্যের কাছে আমাদের অঙ্গীকার ও দৃঢ় মনোবল। ১৯৯৬-এ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। প্রথমেই তিনি সংবিধান থেকে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ সুগম করেন। ’৭৫-এর মর্মন্তুদ ঘটনার পর সামরিক শাসকরা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের শুধু ক্ষমাই করেনি, বিদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসিত করেছে। রাজনৈতিক দল গঠন করে নির্বাচন করার সুযোগ করে দিয়ে বাঙালি জাতিকে কলংকিত করেছে। ২০০১-এ খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে একই কাজ করেছে। ২০০৮-এর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের মধ্য দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বলাভ করেন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কাজ সমাপ্ত করে খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করেন। খুনিচক্রের যারা এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছে আমরা তাদের দেশে এনে দণ্ডাদেশ কার্যকর করার চেষ্টা করে চলেছি।
আজ ভাবতে কত ভালো লাগে, বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত নীতি অনুযায়ী দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তারই সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। দেশে আজ অনেক মেগাপ্রজেক্ট বাস্তবায়িত হওয়ার পথে। যার মধ্যে রয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলারের পায়রা সমুদ্রবন্দর, প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলারের রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প। পদ্মা সেতু ছাড়াও রয়েছে দেশজুড়ে স্পেশাল ইকোনমিক জোন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ইত্যাদি। অতীতে ৭ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশে মানুষের খাদ্যাভাব ছিল, এখন ১৬ কোটি মানুষের দেশে আমরা খাদ্যে উদ্বৃত্ত এবং খাদ্য রফতানিকারক দেশ। একসময় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল না বললেই চলে, আর এখন ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। রেমিটেন্স ১৫ বিলিয়ন ডলার। এক্সপোর্ট ছিল মাত্র ৩০০ মিলিয়ন ডলার, আজ তা ৩৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। শুরুতে বাজেট ছিল মাত্র ৭৮৭ কোটি টাকা, এখন ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশ সম্পর্কে বলছে ‘বিস্ময়কর উত্থান বাংলাদেশের।’ মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস্ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, ‘পরবর্তীকালে যে ১১টি দেশ অর্থনৈতিকভাবে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ তার অন্যতম।’ আরেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জেপি মরগ্যান বলে, ‘বাংলাদেশ উদীয়মান দ্রুতগতির অর্থনীতি’। ইতিমধ্যে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিু-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষপূর্তিতে আমরা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে সক্ষম হব। বঙ্গবন্ধুর দুটি লক্ষ্য ছিল- এক. দেশ স্বাধীন করা এবং দুই. অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। বঙ্গবন্ধু গর্ব করে বলতেন, ‘আমার বাংলা রূপসী বাংলা, আমার বাংলা সোনার বাংলা।’ তিনি বলতেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ।’ একইভাবে ২০০৮-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুকন্যাও বাংলাদেশের মানুষের জন্য দুটি লক্ষ্য স্থির করেছেন- এক. ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং দুই. বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত করা। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়। ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে মোবাইল ও তথ্যপ্রযুক্তির সেবায় দেশের মানুষ ইতিমধ্যে তার সুফল ভোগ করতে শুরু করেছে। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মতে বাংলাদেশ নিু-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে এবং ২০২১-এ আমরা পরিপূর্ণভাবে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছি। ১৯৭১-এ দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩৯ বছর; একই কালপর্বে ভারতের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫০ বছর; আর ২০১৪-এর হিসাবমতে বর্তমানে ভারতের মানুষের গড় আয়ু ৬৬ বছর, পাকিস্তানের ৬৫ বছর আর বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৬৯ বছর।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অগ্রযাত্রা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘গণতন্ত্রকামী জনগণের মনে রাখা দরকার, গণতন্ত্রেও একটা নীতিমালা আছে। গণতন্ত্রের দিশারী যারা তাদের গণতন্ত্রের নীতিকে মানতে হয়। খালি গণতন্ত্র ভোগ করবেন আর নীতিমালা মানবেন না, ওটা হবে না, হতে পারে না।’ আজকের দিনে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অগ্রসর করে নেয়ার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি দল-মত নির্বিশেষে আমাদের সবার জন্য অনুসরণীয়। মানুষের জন্য অপার ভালোবাসা আর তাদের কল্যাণে কাজ করাই বঙ্গবন্ধুর মূল ভাবাদর্শ। নিজ চিন্তা ও আদর্শ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এ নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর এই দরদ আর অকৃত্রিম ভালোবাসার নিরন্তর প্রতিফলন আমরা দেখি তার কন্যা শেখ হাসিনার নীতি-আদর্শ ও কর্মে। শোককে শক্তিতে পরিণত করে জনকল্যাণে নিবেদিত থেকে সংবিধান সমুন্নত রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফলভাবে দেশ পরিচালনা করছেন। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে বাংলাদেশ একদিন উন্নত দেশে রূপান্তরিত হবে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ চেতনা ধারণ করে সমগ্র বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য; বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার