প্রতি বছরই বাজেটের আগে সবেচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ। বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকবে কিনা তা হয়ে ওঠে কোটি টাকার প্রশ্ন। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেও দাবি আসে টাকা সাদা করা সুবিধা দেয়ার। কখনো খাতে বিনিয়োগে কখনো বা সাধারণভাবে জরিমানা দিয়ে পর্দার আড়ালে থাকা এ টাকা বৈধ করার পথ করে দেয়া হয়। জরিমানা দিয়ে টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে আগামী বাজেটেও। তবে বারবার সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগানো না কালো টাকার মালিকরা। আর তাই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দাবি করা, আবার সুযোগ পেলেও তা বিনিয়োগে না আসা রহস্যময় বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
হিসাব মতে, স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত কালো টাকা সাদা হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। ফলে অধরাই থাকছে কালো টাকা, অর্থনীতির মূল ধারার বাইরেই থাকছে এ বিশাল অর্থ। এ অর্থ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকা- ও বিভিন্ন নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি ও দলের পেছনে খরচ করার অভিযোগ রয়েছে। এদিকে দেশে কালো টাকার প্রকৃত পরিমাণ কত কোনো সঠিক সমীক্ষাও নেই। দুই বছর আগে অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে সমীক্ষার ঘোষণা দিলেও তা এখনো শুরু হয়নি।
জানতে চাইলে পলিসি রিসার্স ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সাধারণ অর্থেই কালো টাকা বোআইনি। তাই সুযোগ পেলেও তা সাদা করার ঝুঁকি নেন না এর মালিকরা। কেননা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হলেও পরে যে কোনো সময় এর উৎস সম্পর্কে জানতে চাইতে পারে যে কোনো সংস্থা। তার নৈতিক দিক বিবেচনা করলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া যুক্তিসঙ্গত নয়। কেননা এতে আরো বেশি টাকা বেআইনিভাবে বা অসৎ উপায়ে উপার্জনের জন্য উৎসাহিত করা হয়।
একই বিষয়ে সহমত পোষণ করে অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত বলেন, সাধারণ হিসাবে দেশে ৫ থেকে ৭ লাখ কোটি কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ রয়েছে। তাই কালো টাকার বিষয়টি স্পর্শকাতর। তবে এ টাকা উদ্ধারের প্রয়োজন। এজন্য প্রচলিত আইনে জরিমানা দিয়ে তা সাদা করার বিধান রয়েছে। তবে এমন কোনো কিছু করা উচিত হবে না যাতে সৎ ব্যক্তিরা অসৎ হতে উৎসাহী হয়। এজন্য পৃথক কমিশন গঠন করা উচিত যারা শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে এবং কালো টাকার অর্জনের পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করে তা বন্ধ করতে কাজ করবে।
কেন সুযোগ কাজে লাগানো হচ্ছে না জানতে চাইলে আবুল বারকাত বলেন, বেশি পরিমাণে টাকা বৈধ করতে এনবিআরের দ্বারস্থ হতে হবে। এতে কালো টাকার মালিক হিসেবে নাম লিপিবদ্ধ হয়ে যেতে পারে। সে ভয়েই কেউ এগিয়ে আসেন না।
জানা গেছে, আগামী আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটেও বিভিন্ন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে শর্তহীনভাবে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ চেয়ে এনবিআরের কাছে দাবি জানিয়েছেন আবাসন ব্যবসায়ী ও শিল্প খাতের বিনিয়োগকারীরা।
গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি’ সংস্থা বিভিন্ন দেশের কালো টাকা নিয়ে এক গবেষণা পরিচালনা করে। এ গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় কালো টাকার পরিমাণে বাংলাদেশ বিশ্বে ৫১তম। এ দেশে গত দশক সময়ে (২০০৩-১২) বাংলাদেশের মোট কালো টাকার পরিমাণ ১ হাজার ৩১৬ মিলিয়ন ইউএস ডলার। টাকার পরিমাপে তা প্রায় সাড়ে ১০ লাখ কোটি টাকা। সংস্থাটি উন্নয়নশীল ও উন্নত ১৫১টি দেশের ওপর গবেষণা চালিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করে।
রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ২০ বারের বেশি সুযোগ পেয়েও মূলধারার অর্থনীতিতে কালো টাকা এসেছে মাত্র ১৪ হাজার কোটি টাকা। এ খাতে সরকারের কোষাগারে এসেছে মাত্র ১ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। আর গত ৪৪ বছরে সাদা হয়েছে মাত্র ২ শতাংশের কম টাকা।
বৈঠক শেষে তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরের (২০১৫-১৬) বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ থাকবে। অপছন্দের বিষয় হলেও অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের দাবি উঠেছে। স্বাভাবিক আইনে জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের যে সুযোগ আছে, সেটাই থাকবে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার কীভাবে চিহ্নিত করা যায়, সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অর্থ পাচার করে অনেকে মালয়েশিয়ায় বাড়ি করেছেন। দুবাইতে বাড়ি করেছেন। এগুলো যদি চিহ্নিত করা যায়, তবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।