জার্মানিতে বসবাসরত প্রতিটি অভিভাবকের স্বপ্ন থাকে তার সন্তান স্কুলে ভালো ফলাফল করুক। ‘Abitur’ বা ‘Realschulabschluss’-এ ভালো জিপিএ (যেমন: 1.0 বা 2.0) মানেই আমরা ধরে নেই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত। কিন্তু জার্মানির বাস্তব চিত্রটা কি এতটাই সরল?
সম্প্রতি জার্মানির বড় বড় চাকরিদাতারা (Employers) প্রশ্ন তুলেছেন স্কুলের গ্রেডিং সিস্টেমের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। আপনি যদি বাভারিয়া (Bavaria) থাকেন আর আপনার আত্মীয় যদি বার্লিনে (Berlin) থাকেন—তবে দুজনের বাচ্চার রেজাল্ট কার্ডের ওজন কি সমান? এই প্রশ্নের উত্তর এবং বিস্তারিত বিশ্লেষণ থাকছে আজকের ব্লগে।
সমস্যাটা কোথায়? (The Core Problem)
জার্মানির বিখ্যাত বিজনেস পত্রিকা Handelsblatt-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে একটি উদ্বেগজনক তথ্য। জার্মানির এমপ্লয়ার অ্যাসোসিয়েশনগুলো দাবি করছে, স্কুলগুলোর দেওয়া রেজাল্ট বা গ্রেড এখন আর শিক্ষার্থীদের মেধার আসল পরিচয় বহন করছে না।
তাদের মতে, সার্টিফিকেটে ভালো নম্বর থাকলেও বাস্তবে অনেক প্রার্থীর গণিত (Math) এবং জার্মান ভাষার (German Language) দক্ষতা হতাশাজনক। ফলে আউসবিল্ডুং (Ausbildung) বা চাকরিতে নিয়োগ দিতে গিয়ে কোম্পানিগুলো বিপাকে পড়ছে।
১৬ রাজ্য, ১৬ রকম নিয়ম (Educational Federalism)
জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থা মূলত ‘Ländersache’ বা রাজ্যের বিষয়। অর্থাৎ, স্কুল কীভাবে চলবে, সিলেবাস কী হবে বা পরীক্ষার খাতা কতটা কড়াকড়িভাবে দেখা হবে—তা ঠিক করে প্রতিটি রাজ্য (Bundesland) আলাদাভাবে। এর ফলে তৈরি হয়েছে বিশাল বৈষম্য:
- কঠিন বনাম সহজ: পরিসংখ্যান বলে, বাভারিয়া (Bavaria) বা স্যাক্সনি (Saxony)-তে ভালো রেজাল্ট করা যতটা কঠিন, বার্লিন (Berlin) বা ব্রেমেন (Bremen)-এ ভালো গ্রেড পাওয়া তুলনায় কিছুটা সহজ।
- তুলনার অভাব: একজন নিয়োগকর্তার পক্ষে বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে যে, এক রাজ্যের ‘গ্রেড ২’ অন্য রাজ্যের ‘গ্রেড ১’-এর চেয়ে ভালো নাকি খারাপ।
চাকরিদাতারা আসলে কী চাইছেন?
এমপ্লয়াররা সরকারের কাছে একটি জাতীয় শিক্ষা রেজিস্টার (National Education Register) বা ডাটাবেস তৈরির দাবি জানিয়েছেন। তাদের মূল দাবিগুলো হলো:
- স্বচ্ছতা (Transparency): কোন স্কুলের শিক্ষার মান কেমন, তা পরিষ্কারভাবে জানতে চাওয়া।
- তুলনামূলক ডাটা: রাজ্যগুলোর মধ্যে শিক্ষার মানের পার্থক্য কমিয়ে আনা।
- বেসিক স্কিল: শুধু গ্রেড নয়, ছাত্রছাত্রীরা আসলেই পড়ালেখা বুঝছে কিনা—তা নিশ্চিত করা।
📌 প্রবাসী অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের করণীয় কী?
আমরা যারা বাংলাদেশ বা অন্য দেশ থেকে এসেছি, তাদের জন্য এই বিষয়টি বোঝা অত্যন্ত জরুরি। শুধু সার্টিফিকেটের ওপর ভরসা করে বসে থাকলে চলবে না। জার্মানির জব মার্কেটে টিকতে হলে আপনাকে বা আপনার সন্তানকে নিচের বিষয়গুলোতে ফোকাস করতে হবে:
১. ‘গ্রেড’ নয়, ‘দক্ষতা’ বাড়ান
আপনার সন্তানের রেজাল্ট কার্ডে ‘১’ (Sehr Gut) থাকলে খুশি হোন, কিন্তু সন্তুষ্ট হবেন না। খেয়াল করুন সে আসলেই অংক বা ভাষার ব্যাকরণটা বুঝছে কিনা। প্রয়োজনে অতিরিক্ত টিউটর (Nachhilfe) বা অনলাইন কোর্সের সাহায্য নিন।
২. প্র্যাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা (Praktikum)
জার্মানিতে কাজের অভিজ্ঞতার মূল্য সার্টিফিকেটের চেয়েও বেশি। স্কুল ছুটির সময় বা গ্যাপ ইয়ারে ‘Praktikum’ (Internship) করাটা খুব জরুরি। এতে নিয়োগকর্তারা বুঝতে পারেন যে, প্রার্থী বাস্তব কাজ সম্পর্কে ধারণা রাখে।
৩. অতিরিক্ত যোগ্যতা (Extra Qualifications)
স্কুলের পড়ার বাইরে কম্পিউটার স্কিল, আইটি নলেজ বা অন্য কোনো বিদেশি ভাষা (যেমন: ইংরেজি বা স্প্যানিশ) জানা থাকলে তা সিভিতে (CV) বিশাল ভ্যালু অ্যাড করে।
উপসংহার
জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম সেরা, এতে সন্দেহ নেই। তবে রাজ্যভেদে মানের পার্থক্য একটি বড় বাস্তবতা। নতুন নিয়ম বা সংস্কার আসতে সময় লাগবে। তাই প্রবাসী হিসেবে আমাদের উচিত বাস্তবতা মেনে নিয়ে নিজেদের সন্তানদের “Certificated” হওয়ার পাশাপাশি “Skilled” হিসেবে গড়ে তোলা।
দিনশেষে, জার্মানির জব মার্কেটে আপনার ‘কাগজ’ আপনাকে ইন্টারভিউ পর্যন্ত নিয়ে যাবে, কিন্তু আপনার ‘দক্ষতা’ আপনাকে চাকরিটি পাইয়ে দেবে।
তথ্যসূত্র:
1. Handelsblatt Report: “Arbeitgeber wollen Daten zu Schulleistungen erfassen lassen”
2. INSM-Bildungsmonitor (Initiative Neue Soziale Marktwirtschaft)
🔗 আরও পড়ুন:
জার্মানিতে আউসবিল্ডুং পাওয়ার উপায়
জার্মান স্কুল সিস্টেম: Grundschule থেকে Gymnasium


