বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার একটি সমঝোতা সই করেছে মিয়ানমার। ‘রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের ফেরার ব্যবস্থা’ শীর্ষক এই সমঝোতার বিষয়ে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, দুই মাসের মধ্যে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত লোকজনের ফিরে যাওয়া শুরু হবে।
প্রত্যাবাসনের জন্য ভৌত ব্যবস্থাবিষয়ক একটি সুনির্দিষ্ট দ্বিপক্ষীয় দলিল দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করা হবে। তবে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মূলত আন্তর্জাতিক চাপ কমানোর চেষ্টার অংশ হিসেবেই মিয়ানমার এই সমঝোতা সই করেছে।
যদিও মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের দপ্তর এই সমঝোতাকে উভয় দেশের জন্য জয় হিসেবে উল্লেখ করেছে। ওই দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এবার ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থার ভিত্তি হবে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সই করা যৌথ বিবৃতি। সেখানে রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের ধারাবাহিকভাবে পরিচয় যাচাই ও মিয়ানমারের গ্রহণ করার বিষয়ে সাধারণ নীতি ও নির্দেশিকা রয়েছে।
নেপিডোতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির সঙ্গে গতকাল সকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর বৈঠকের পর দুই দেশ ওই সমঝোতায় সই করে।
উল্লেখ্য, গত অক্টোবরে মিয়ানমার ১৯৯২ সালের যৌথ বিবৃতির আলোকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রস্তাব দিলেও বাংলাদেশ এর বিরোধিতা করে বলেছিল, ১৯৯২ সালের চেয়ে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। তাই রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি বিবেচনা করে নতুন সমঝোতা প্রয়োজন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও এ বিষয়ে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের অবহিত করেছিলেন।
বাংলাদেশের মূল যুক্তি ছিল, ১৯৯২ সালের যৌথ বিবৃতিতে যেভাবে রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই করার কথা বলা হয়েছিল সেটি এবার করা হলে এ দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগের মিয়ানমারের বাসিন্দা হিসেবে প্রমাণ করা কঠিন হতে পারে। কেননা রাখাইন রাজ্যে এবার তাদের বাড়িঘর এমনভাবে পোড়ানো হয়েছে যে সেখানে তাদের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমঝোতার বিষয়ে যতটুকু জানা গেছে তাতে যে খুব নতুন কিছু আছে এমন নয়। কেবল একটি বিষয় নতুন রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী নেপিডোতে সাংবাদিকদের বলেছেন এবং পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কার্যক্রম আগামী দুই মাসের মধ্যে শুরু করা হবে। এটি কবে নাগাদ শেষ হবে সেটি বলা হয়নি। এর আগে মিয়ানমার বলেছিল, তারা যাচাই-বাছাই করেই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে। মিয়ানমার গতকাল যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে সেখানেও তা পুনর্ব্যক্ত করেছে।
রোহিঙ্গারা কিভাবে যাবে, তাদের যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া কী হবে—এসব বিষয় নির্ধারণ করবে দুই দেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ। মিয়ানমারের একজন কর্মকর্তা একটি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাকে বলেছেন, কিভাবে পরিচয় নিশ্চিত করা হবে তার একটি নমুনা ফরম বা তালিকা তারা বাংলাদেশকে দিয়েছেন। বাংলাদেশ যদি তাতে রাজি হয় তবে সেটির ভিত্তিতেই কাজ করা হবে।
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা হলো, মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় অতীতে তেমন একটা ফল আসেনি। ২০০৫ সাল থেকে মিয়ানমার একতরফাভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বন্ধ রেখেছে। দ্বিপক্ষীয় বিষয় হলে মিয়ানমার নানা টালবাহানা করে বিষয়টি পিছিয়ে দেয়। কিন্তু গতকাল বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বিজ্ঞপ্তি থেকে বোঝা যাচ্ছে এখানে কোনো বহুপক্ষীয় উদ্যোগ হচ্ছে না। এটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বিষয় হিসেবেই থাকছে। মিয়ানমার তার বিজ্ঞপ্তিতে রোহিঙ্গা সংকটের আন্তর্জাতিকীকরণের বিরোধিতা করেছে।
বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুকে যেভাবে আন্তর্জাতিকীকরণ করেছে বা করতে চেয়েছিল মিয়ানমার তা পছন্দ করছে না। বিবৃতিতে তারা বলেছে, বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়ভাবেই সমাধান করতে হবে।
তবে অন্য আন্তর্জাতিক চাপগুলোও এখানে কাজ করেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। যেমন—গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের কথা বিবেচনার কথা বলেছেন। সেই প্রেক্ষাপটে খুব তড়িঘড়ি করেই মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বার্তা দিতে চাচ্ছে যে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে, যাতে তাদের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ কিছুটা হলেও লাঘব হয়।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, প্রত্যাবাসনবিষয়ক সমঝোতা হলেও রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়া নির্ভর করছে পুরোপুরি তাদের ইচ্ছার ওপর। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চায় না রোহিঙ্গাদের জোর করে ফেরত পাঠানো হোক। বাংলাদেশের এমন পরিকল্পনা নেই। বাংলাদেশ চায়, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন। এর জন্য মিয়ানমার সরকারকেই রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে। আর এটি রাতারাতি বা দুই মাসে সম্ভব নয়।
বাংলাদেশি এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে নেপিডো থেকে বার্তা সংস্থা ইউএনবি জানায়, গত বুধবার নেপিডোয় জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে সমঝোতায় একটি সময়সীমা রাখার কথা মিয়ানমারকে বলেছিল। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও সম্পৃক্ত করতে চেয়েছিল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী এবং মিয়ানমারের পক্ষে স্টেট কাউন্সেলরের দপ্তরের মন্ত্রী কিয়াও তিন সুয়ে ওই সমঝোতায় সই করেন। এ সময় তাঁরা ১৯৯৮ সালে দুই দেশের মধ্যে সই হওয়া সীমান্ত চুক্তি অনুস্বাক্ষর দলিল বিনিময় করেন। তাঁরা ২০০৭ সালে সম্মত ‘নাফ নদীতে সীমান্ত নির্ধারণী অতিরিক্ত প্রটোকল’ও সই করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল সকালে নেপিডোয় মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ইউন মিয়াত আয়ের সঙ্গে দেখা করে রাখাইন রাজ্যের জন্য উপহার হিসেবে তিনটি অ্যাম্বুল্যাসও দিয়েছেন।
গতকাল বিকেলে ঢাকায় একটি সম্মেলন শেষে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রথম ধাপ। এটি গুরুত্বপূর্ণ। আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শনিবার ঢাকায় এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করবেন।